সপ্তাহের সেরা

    আখ্যাত রচনা

    সাতঘরিয়া

    মনপত্থল গাঁয়ের সামনের দিকে সরকারী পাকা সড়ক; এখানে যাকে বলে পাক্কী। পেছনে দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাত। কোয়েল এখন নামেই নদী। এই জেঠ মাহিনা অর্থাৎ জষ্ঠি মাসে বাদামী বালির পাহাড়ের তলায় যে জলটুকু রয়েছে তাতে হাঁটুও ডোবে না।

    মনপত্থল জল-অচল অচ্ছুৎদের গাঁ। এর উত্তর দিকে থাকে ধাঙড়েরা, দক্ষিণে গঞ্জুরা, পশ্চিমে দোসাদরা।

    ভোরবেলা দোসাদটোলার চাঁপিয়া কোয়েলের হাঁটুভর পানিতে নাহানা (স্নান) সেরে নিজের ধসে-পড়া কোমর-বাঁকা ঘরটার দাওয়ায় বসে আছে। আর থেকে থেকেই থুতনি তুলে চনমন করে দূরে পাক্কীর দিকে তাকাচ্ছে। ঐ সড়কটা ধরে পুব দিক থেকে নাটোয়ারের আসার কথা।

    এত ভোরে গঞ্জুটোলা ধাঙড়টোলা বা দোসাদটোলায় কারও ঘুম ভাঙেনি। তবে ধাঙড়পাড়ার পাল পাল শুয়োর এর মধ্যেই খাদ্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। জানোয়ারগুলোর পেটে সারাক্ষণ রাহুর খিদে। শুয়োর ছাড়া আর যারা জেগেছে তারা হল পাখি। ঝাঁক ঝাঁক পরদেশী শুগা আর চোটা পাখি ডানায় বাতাস চিরে চিরে পাক্কীর ওধারে ধু-ধু মাঠের দিকে উড়ে যাচ্ছে।

    মনপত্থলের যে ধারেই তাকানো যাক, পরাস সিমার গাছের ছড়াছড়ি। তিন মাস আগে সেই যে গাছগুলো থোকায় থোকায় লাল ডগডগে ফুল ফোটাতে শুরু করেছিল, এখনও ফুটিয়েই যাচ্ছে। আর আছে সফেদিয়া গোলগোলি এবং মনরঙ্গোলি গাছের অজস্র ঝোপ। প্রতিটি ঝোপের মাথায় শুধু ফুল আর ফুল।

    মনুষ্যজাতির সব চাইতে নিচের স্তরের যে অংশটি সারা পৃথিবী থেকে ভয়ে ভয়ে দূরে সরে এসে এই মনপত্থলে ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে তাদের কেউ এই মুহূর্তে জেগে থাকলে, চাঁপিয়াকে দেখে একেবারে হাঁ হয়ে যেত।

    দুসাদিন চাঁপিয়ার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। গায়ের রঙ পোড়া ঝামার মত। চুল উঠে উঠে কপালটা প্রকাণ্ড মাঠ হয়ে গেছে। নাকটা খাট এবং চাপা। থুতনিতে কাটা দাগের মত খাঁজ। মোটা ভুরু, খসখসে চামড়া। তবু লক্ষ্য করলে টের পাওয়া যায়, চাঁপিয়ার লম্বাটে মুখে এককালে খানিকটা ছিরিছাঁদ ছিল। এই বয়সেও তার চোখ দুটো বড় সরল, বড় নিষ্পাপ এবং টানা টানা। বিশ-পঁচিশ সাল আগে যখন চাঁপিয়া সবে নঈ যুবতী হয়ে উঠেছে, সেই সময় গঞ্জুটোলার ফেকুমল প্রায়ই বলত, তার চোখ নাকি বনহরণা অর্থাৎ বনহরিণীর মত। ছোকরা ছিল বেজায় ফুর্তিবাজ, আমুদে। নৌটঙ্কির দলে গান গাইত আর আজীব আজীব কথা বলে লোককে তাক লাগিয়ে দিত।

    বনহরণার মত চাঁপিয়ার চোখ হোক বা না হোক, তার গায়ে ছিল বনভৈসির তাকত। অসীম শক্তি আর অফুরন্ত স্বাস্থ্যই তাকে জীবনের লম্বা অনেকগুলো বছর এই পৃথিবীতে টিকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তিন বছর আগে খারাপ জাতের চেচকে (বসন্তে) চাঁপিয়ার অটুট শরীর ভেঙে গেছে। কণ্ঠার হাড় গজালের মত ফুঁড়ে বেরিয়েছে। মুখে, ঘাড়ে, গলায় বসন্তের কালো কালো দাগ। হাতের শিরগুলো দড়ি হয়ে চামড়ার তলা থেকে ফুটে উঠেছে। আজকাল দুব্‌লা শরীরে অল্পতেই হাঁফ ধরে যায় তার।

    একটা রোগা ভাঙাচোরা চেহারার আধবুড়ি দুসাদিনের দিকে তাকিয়ে গঞ্জুরা, ধাঙড়রা বা দোসাদরা নিশ্চয়ই হাঁ হয়ে যাবে না। তাদের অবাক হওয়ার কারণ হল চাঁপিয়ার সাজগোজ। এই মুহূর্তে তার পরনে বাদরার ছাই (এক ধরনের ক্ষার) দিয়ে কাচা পরিষ্কার রঙিন একটা শাড়ি আর খাটো জামা। চোখে কাজলের লম্বা টান। চুলগুলো কাঠের কাকাই দিয়ে চুড়ো করে বেঁধে চারপাশে মনরঙ্গোলি ফুল বসিয়ে দিয়েছে। কপালের মাঝখানে মেটে সিঁদুরের ফোঁটা। গলায় চাঁদির হার, কানে চাঁদির করণফুল, হাতে চাঁদির কাঙনা। গত তিন সাল বড় কষ্টে গেছে চাঁদিয়ার, বহোত তখলিফ। কত দিন পেটে দানা পড়েনি, বিলকুল ভুখা থাকতে হয়েছে। তবু প্রাণ ধরে চাঁদির এই গহনা কটা সে যে বেচতে পারেনি তার কারণ একটাই। হাজার দুঃখেও চাঁপিয়ার আশা বা স্বপ্ন ছিল জীবন আরও একবার সে সাজাতে পারবে। আজ তার সেই সাজার দিন।

    সেই পনের বছর বয়স থেকে এখন পর্যন্ত মোট ছ’বার এভাবে সেজেছে চাঁপিয়া। মনপত্থলের অচ্ছুতেরা তাকে শেষবার সাজতে দেখেছে পাঁচ সাল আগে। সেবার চাঁপিয়া তার ছ’নম্বর মরদের ঘর করতে যায়।

    মনপত্থলকে ঘিরে দশ-বিশটা গাঁয়ে চাঁপিয়ার আরেক নাম ছেঘরিয়া অর্থাৎ চল্লিশ বছরের জীবনে মোট ছ’টি পুরুষের ঘর করেছে সে আজ পর্যন্ত।

    ঘরের দাওয়ায় বসে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠতে থাকে চাঁপিয়া। চারপাশের দোসাটোলা, গঞ্জুটোলা, ধাঙড়টোলা, ঝাঁক ঝাঁক পরদেশি পাখি, পাল পাল শুয়োর, সিমার বা পরাস গাছের মাথায় থোকা থোকা আগুন, অনেক দূরে ধু-ধু ফাঁকা মাঠ—কোনদিকেই লক্ষ নেই তার। পাকা সড়কের ওপর চাঁপিয়ার দুই চোখ স্থির হয়ে আছে।

    কথা আছে, দু’মিল (দু’মাইল) পুবের ছোট টৌন ভকিলগঞ্জ থেকে সুরয উঠবার ঢের আগেই নাটোয়ার এসে তাকে নিয়ে সোজা চলে যাবে আড়াই ‘কোশ’ পশ্চিমে সুরথপুরার হাটে। নাটোয়ার তারই স্বজাত অর্থাৎ কিনা দোসাদ। বয়স কমসে কম পঞ্চাশ হবেই। ভকিলগঞ্জে এক ঠিকাদারের কাছে দিনমজুরিতে মাটি কাটে। ওদিকটায় এখন সড়ক তৈরির কাজ চলছে। তার জন্যই মাটি কাটা।

    দেখতে দেখতে চারদিক দ্রুত ফর্সা হতে থাকে। অনেক, অনেক দূরে আকাশ যেখানে পিঠ বাঁকিয়ে দিগন্তে নেমেছে, ঠিক সেইখানে লাল টকটকে সূর্যটা একটু একটু করে মাথা তোলে। ধাঙড়, গঞ্জু আর দোসাদটোলা থেকে মানুষজনের গলা ভেসে আসে। টের পাওয়া যায় মনপত্থল গাঁ জাগতে শুরু করেছে।

    সুরয উঠে গেল, অথচ এখনও নাটোয়ারের দেখা নেই। তবে কি সে আসবে না? ভাবতেই বুকের ভেতর চল্লিশ বছরের দুব্‌লা হৃৎপিণ্ড থমকে যায় চাঁপিয়ার। চোখ জলে ভরে যেতে থাকে। নাটোয়ার দোসাদ না এলে তার এত সাজ ব্যর্থ হয়ে যাবে।

    আরও খানিকক্ষণ পর সূর্য যখন দিগন্তের তলা থেকে লাফ দিয়ে ওপরে উঠে আসে, সে সময় দেখা যায় পাক্কী ধরে নাটোয়ার এদিকেই আসছে। বুকের ভেতর থমকান হৃৎপিণ্ড বিপুল বেগে ছোটাছুটি শুরু করে। খুশিতে চোখমুখ চকচকিয়ে ওঠে চাঁপিয়ার।

    একটু পরে ডাইনে এবং বাঁয়ে ধাঙড় আর গঞ্জুটোলা রেখে দোসাদটোলায় ঢুকে পড়ে নাটোয়ার। তারপর সামনের সিমার আর পরাস গাছগুলোর তলা দিয়ে সোজা চাঁপিয়ার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাজের বাহার দেখতে দেখতে শুধোয়, ‘কা রে চাঁপিয়া, রিডি?’ ‘রিডি’ মানে রেডি। চাঁপিয়া প্রস্তুত হয়ে আছে কি না তা জানতে চাইছে নাটোয়ার। ঠিকাদারদের কাছে কাজ করে দু-চারটে আংরেজি বুলি শিখে ফেলেছে সে। কথায় কথায় হরদম সেগুলো বেরিয়ে আসে।

    ‘হাঁ—’, আস্তে ঘাড় হেলিয়ে দেয় চাঁপিয়া। নাটোয়ারের দিকে ভাল করে তাকাতে পারে না সে। পনের ষোল বছরের নঈ যুবতী সে আর নেই। তবু তার বুক সুখে এবং লজ্জায় থির থির করে কাঁপতে থাকে।

    ‘আমার আসতে থোড়া দের হয়ে গেল।’

    চাঁপিয়া কী উত্তরে দেবে, ভেবে পেল না।

    নাটোয়ার ফের বলে, ‘আর দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে। সুরয চড়ে যাচ্ছে। জলদি চল্। সুরথপুরার হাটিয়ায় পৌঁছতে দুফার হয়ে যাবে।’

    আবছা গলায় চাঁপিয়া বলে, ‘থোড়া ঠার যাও।’ বলেই তার ভাঙাচোরা ফুটোফাটা ঘরের ভেতর ঢুকে একটা পুঁটলি নিয়ে বেরিয়ে আসে। পুঁটলিটা কাল রাতেই বেঁধে-ছেঁদে রেখেছিল সে। ওটার ভেতর রয়েছে তার যাবতীয় পার্থিব সম্পত্তি। মোট খান দুই সেলাই করা খাটো বহরের শাড়ি, তিনটে ছেঁড়া জামা, একটা কাঁথা, একটা কম্বল আর সিলভারের তোবড়ানো দু-তিনটে থালা-গেলাস।

    নাটোয়ার পুঁটলিটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে শুধোয়, ‘এটা নিয়ে যাবি?’

    ‘হাঁ—’, চাঁপিয়া মাথা নাড়ে।

    ‘ঠিক হ্যায়। চল্—’

    কয়েক পা এগিয়ে একবার পেছন ফেরে চাঁপিয়া। হেলে-পড়া টুটাফুটা ঘরটা একবার দেখে নেয়। এটা তার বাপের ঘর। অবশ্য বাপ আর বেঁচে নেই; কবেই মরে ফৌত হয়ে গেছে। শুধু কি বাপ, মা-বোন কেউ নেই তার। এক ভাই ছিল; সাদির পর অনেক দূরের ভারি টৌন ঝরিয়ায় চলে গেছে। সেখানে কয়লা খাদানে কাজ করত। দশ-বিশ সাল তার কোনও খবর পায় না চাঁপিয়া। মরে গেছে কী বেঁচে আছে, কে জানে।

    বাপের এই ঘর থেকে এই প্রথম যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি কাঁখে নিয়ে একজন মরদের পিছু পিছু চলে যাচ্ছে না চাঁপিয়া। আগেও ছ’ ছ’বার পুরুষের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। যাবার সময় প্রতিবারই মনে মনে বলেছে, ‘হো রামজি, হো কিষুণজি, আর যেন আমাকে বাপের ঘরে ফিরতে না হয়।’ কিন্তু দো সাল, চার সাল পরপরই ছে-ঘরিয়া চাঁপিয়াকে ফিরে আসতে হয়েছে।

    এবার হল সপ্তম বার। ঘরটা দেখতে দেখতে মনে মনে হাত জোড় করে রামচন্দজি এবং কিষুণজির উদ্দেশ্যে চাঁপিয়া প্রার্থনা জানায়, এই যেন তার শেষ যাওয়া হয়।

    নাটোয়ার তাড়া লাগায়, ‘কী রে, দাঁড়িয়ে গেলি যে, দের নায় করনা—’

    ‘নায়—’ মুখ ফিরিয়ে নাটোয়ারের পিছু পিছু আবার হাঁটতে শুরু করে চাঁপিয়া। যেতে যেতে লক্ষ্য করে, হট্টাকট্টা চেহারার আধবুড়ো নাটোয়ারের সাজের বহরও আজ কম না। এমনিতে তার যা কাজ তাতে একরকম সারা দিনই মাটি মেখে পিরেত সেজে থাকে। কিন্তু আজ এর মধ্যেই সারা গায়ে প্রচুর তেল মেখে ‘নাহানা’ সেরে নিয়েছে নাটোয়ার। মাথায় এত কড়ুয়া তেল ঢেলেছে যে, এখনও কপাল বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে। তার পরনে ক্ষারে-কাচা সফেদ ধুতি আর লাল জামা। পায়ে কাঁচা চামড়ার ভারি জুতো, কানে পেতলের মাকড়ি। কাঁধের ওপর নতুন কোরা গামছা।

    দোসাদটোলা পেছনে ফেলে গঞ্জু আর ধাঙড়টোলার ভেতর দিয়ে দু’জনে এগিয়ে যেতে থাকে। এর মধ্যে মনপত্থল গাঁয়ের যাদেরই ঘুম ভেঙেছে দুলহনের সাজে চাঁপিয়াকে দেখে তারা তাজ্জব বনে যায়। জিজ্ঞেস করে, ‘কা রে চাঁপিয়া, নয়া মরদ মিলল হো?’

    মুখে কিছু বলে না চাঁপিয়া। চোখ নামিয়ে আস্তে মাথা নাড়ে শুধু।

    ‘এবার তা হলে সাতঘরিয়া হবি!’

    চাঁপিয়া চুপ।

    মনপত্থলের বয়স্ক মানুষজনেরা তার হিতাকাঙ্ক্ষী। তারা চেঁচিয়ে পরামর্শ দেয়, ‘দেখিস, এই সাদিটা যেন টুটে না যায়।’

    এর আগে ছ’ ছ’বার সাদি হয়েছে চাঁপিয়ার। ছ’বারই ভেঙে গেছে। মনে মনে তার ইচ্ছা শ্মশানে না চড়া পর্যন্ত এই সাদি যেন অটুটই থাকে। হো রামজি, হো কিষুণজি, তেরে কিরপা।

    একসময় দু’জনের মনপত্থল গাঁ থেকে বেরিয়ে সোজা পাক্কীতে এসে ওঠে; তারপর সুরথপুরা হাটের দিকে যেতে থাকে। গাঁয়ের ভেতর দিয়ে যখন আসছিল তখন দু’জনে আগে-পিছে হাঁটছিল। যে মরদের সঙ্গে এখনও সাদি হয়নি, গাঁয়ের মানুষের চোখের সামনে তার গা ঘেঁষে চলা যায় নাকি? শরম লাগে না? এই শরমটা নাটোয়ারের মধ্যেও কাজ করছিল খুব সম্ভব। গাঁয়ের ভেতরে বরাবর চাঁপিয়ার কাছ থেকে খানিকটা ফারাক রেখে চলেছে সে। কিন্তু পাকা সড়কে জান-পয়চান কেউ নেই। এখানে চাঁপিয়ার পাশাপাশি হাঁটতে অসুবিধা কোথায়?

    চলতে চলতে বারবার সঙ্গিনীর দিকে তাকায় নাটোয়ার। চাঁপিয়াও তার সঙ্গীকে আড়ে আড়ে দেখতে থাকে। এভাবে মাঝে মাঝে দু’জনের চোখাচোখি হয়ে যায়।

    হাজার হোক, চাঁপিয়া একটা রক্তমাংসের জীবন্ত আওরত। মনুষ্যজাতি সম্পর্কে তার বিপুল অভিজ্ঞতা। নাটোয়ারের তাকানো দেখে এক লহমায় বুঝে নেয়, তাকে ‘পুরুখ’ বা পুরুষটার মনে ধরেছে।

    চাঁপিয়ার মনে পড়ে, প্রথমবার ছাড়া বাকি পাঁচবারই এভাবে একটা করে পুরুষের সঙ্গে সুরথপুরার হাটে গেছে। প্রথমবার যেতে হয়নি, তার কারণ তখন বাপ বেঁচে ছিল। সে-ই চারপাশের দশ-বিশটা তালুক চষে মনপছন্দ একটা ছেলে খুঁজে এনে তার সাদি দেয়। বিয়ের পর মনপত্থল থেকে আট ‘মিল’ উত্তরে হাথিয়াগঞ্জে মরদের ঘর করতে চলে যায় চাঁপিয়া।

    জীবনের প্রথম ‘পুরুখ’ মুঙ্গিলাল ছিল বড়ই সাদাসিধে ভাল মানুষ গোছের আদমী। সংসারে সে আর তার একটা বুড়ি পিসী ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। এক রাজপুত ক্ষত্রিয়ের জমিতে মুঙ্গিলাল ছিল কামিয়া অর্থাৎ খরিদী কিষাণ। তার নানা জমি-মালিকের কাছ থেকে কোরা কাগজে অঙ্গুঠার ছাপ মেরে টাকা করজ নিয়েছিল। সে টাকা নিজে আর শোধ করে যেতে পারেনি। ফলে বাকি জীবন নানাকে মালিকের জমিতে স্রেফ পেটভাতায় ঘাড় গুঁজে খেটে যেতে হয়েছে। নানার পর বাপ মৃত্যু পর্যন্ত ঐ মালিকেরই জমি চষে গেছে। তারপর মুঙ্গিলালের পালা। কিন্তু সুদে-আসলে করজের টাকা ফুলেফেঁপে এতই বিরাট হয়ে উঠেছে যে, তিন পুরুষ ধরে অবিরত খেটেও শোধ করা যাচ্ছিল না।

    সাদির পর চাঁপিয়াকেও মালিকের ক্ষেতির কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল মুঙ্গিলাল। দু’জনে খেটে যত তাড়াতাড়ি কামিয়াগিরি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, এই ছিল তার ইচ্ছা। কিন্তু দুটো সাল ঘুরতে না ঘুরতেই দশ দিনের ‘বোখারে’ হঠাৎ মরে গেল মুঙ্গিলাল। মরদের মৃত্যুশোক সামাল দিয়ে উঠতে না উঠতে মালিকের মুনশি আধবুড়ো পিঠবাঁকা চিমসে চেহারার টেড়ারাম সহায় একদিন রাত্রে তার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে একটা প্রস্তাব দেয়। সে তাকে ‘রাখনি’ (রক্ষিতা) করতে চায়। এমনি এমনি মুফতে না। রীতিমত সপরনার (সাজসজ্জা) জিনিস দেবে। নয়া শাড়ি দেবে, চাঁদির গয়না দেবে, এ ছাড়া পাইসা-রুপাইয়া তো আছেই।

    অচ্ছুৎ ভূমিদাসদের ঘরের যুবতী মেয়েদের মালিক এবং তাদের লোকেরা চিরদিন ভোগদখল করে এসেছে। আবহমান কাল ধরে এ অঞ্চলে এ একটা চালু-প্রথা। এর বিরুদ্ধে কেউ কখনও মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। কিন্তু চাঁপিয়া অন্য ধাতের তেজী মেয়ে। তা ছাড়া মুঙ্গিলালের শোকটা তখনও তার মনে বড়ই টাটকা। আচমকা তার মাথায় কী যেন হয়ে যায়। ‘বুড়হা গিধ, তুহারকা মুহ্‌মে থুক থুক থুক—’ গালাগাল দিয়ে এবং টেড়ারামের মুখে গুনে গুনে তিনবার থুতু ছিটিয়েই চাঁপিয়ার হুঁশ হয়, হাথিয়াগঞ্জে আর থাকা ঠিক হবে না। টেড়ারাম তাকে নির্ঘাত খুন করে ফেলবে।

    একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চাঁপিয়া রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে শুরু করে এবং রাতারাতি ক্ষেতির পর ক্ষেতি পেরিয়ে সোজা মনপত্থলে বাপের ঘরে ফিরে আসে।

    বাপ গণপৎ দোসাদ কমজোরি মানুষ। সে ছিল মরসুমি কিষাণ। ধান কি গেঁহু চাষের সময় আর ফসল কাটার মরসুমে দেড় আর দেড় মোট তিনটে মাস সে কাজ পেত। বাকি ন’ মাস দক্ষিণ কোয়েলের পাড়ে যে মাইলের পর মাইল জুড়ে জঙ্গল পড়ে আছে সেখান থেকে সুথনি (একজাতীয় কন্দ), রামদানা, মেটে আলু বা মহুয়ার গোটা তুলে এনে খেয়ে জীবন বাঁচাত। মুঙ্গিলালের সঙ্গে সাদির আগে বাপের পিছু পিছু খাদ্যের খোঁজে কতবার সে ঐ জঙ্গলটায় গেছে। হাথিয়াগঞ্জ থেকে ফেরার পর রোজই সেখানে যেতে লাগল চাঁপিয়া।

    দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু চাঁপিয়ার বরাত এমনই, মুঙ্গিলালের মৃত্যুর পর ছ’মাস ঘুরল না, বাপটা মরে ফৌত হয়ে গেল।

    দুব্‌লা হোক, বুড়হা হোক, হাজামজা হোক, তবু মাথার ওপর একটা বাপ ছিল। সে চোখ বোজার পর রাতের অন্ধকারে কারা যেন ঘরের বেড়া আঁচড়াতে আর চাপা গলায় বলত, ‘দরবাজা খোল চাঁপিয়া। তোর জন্যে লাড্ডুয়া এনেছি, বুনিয়া এনেছি, চাঁদির করণফুল এনেছি—’

    বাপ মরার পর থেকেই শিয়রের কাছে একটা বাঁকানো দা নিয়ে শুতো চাঁপিয়া। দা’টা বাগিয়ে বিছানায় উঠে বসে সে গলার শির ছিঁড়ে চেঁচাত, ‘ভাগ যা চুহাকা ছৌয়ারা। নইলে জানে খতম হয়ে যাবি।’

    কিন্তু উৎপাতটা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। অতিষ্ঠ চাঁপিয়া শেষ পর্যন্ত মনপত্থলের পঞ্চ-এর কাছে গিয়ে নালিশ জানায়। ‘পঞ্চ’-এর যে মাথা সে হল গঞ্জুটোলার বুড়ো ধানপত। সব শুনে সে বলেছিল, যুবতী ছোকরির অরক্ষিত থাকা ঠিক না। চাঁপিয়ার উচিত তুরন্ত আরেকবার সাদি করে ফেলা। বেশির ভাগ ‘পুরুখে’র (পুরুষের) মধ্যেই রয়েছে একটা করে জানবর। চাঁপিয়ার শরীরে এবং মনে তাকত কতটুকু? জানবরেরা তাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।

    ধানপত ভাল লোক, বহোত সাচ্চা আদমী। তার কথাগুলো ফেলে দেবার মত নয়। চাঁপিয়া বলেছিল, ‘লেকেন আমি একঘরিয়া রাণ্ডি, আমাকে কে সাদি করবে?’

    ধানপত বলেছিল, ‘কা তাজ্জবকা বাত! আমাদের অচ্ছুতিয়াদের ঘরে একঘরিয়াদের নতুন করে সাদি হয় না! কেত্তে দোঘরিয়া চারঘরিয়া দশঘরিয়া চুমৌনা (সাঙ্গা) করে সম্‌সার করছে।’

    কথাটা চাঁপিয়ার অজানা নয়। দোসাদ সমাজের যাবতীয় প্রথাই সে জানে। নিজের দ্বিতীয়বার সাদির প্রসঙ্গে ঠিক ওভাবে সে বলতেও চায়নি। দ্রুত শুধরে নিয়ে সে এবার বলেছে, ‘জানি চাচা। লেকেন আমি একটা লেড়কি, মাথার ওপর বাপ নেই। কোই ভি নায়। লোকের দরজায় দরজায় ঘুরে কি বলতে পারি আমাকে সাদি কর। শরমকা বাত।’

    ‘তুই রাজি থাকলে বল্। আমি ব্যওস্থা করব।’

    ‘তোমার যা ‘আচ্ছা’ মনে হয়, কর।’

    কয়েক দিনের মধ্যেই পাশের তালুক দুধলিগঞ্জ থেকে আধবুড়ো এক দোসাদকে এনে হাজির করেছিল ধানপত। লোকটার নাম চৌপটলাল। দু’জনের আলাপ-টালাপ করিয়ে দিয়ে ধানপত জানিয়েছিল, চৌপট পাক্কীতে সাইকেল রিকশা চালায়। আগে দু’বার বিয়ে করেছে। এক বউ মারা গেছে বোখারে, আরেক বিয়ে ‘ছুট’ হয়ে গেছে। ছেলেপুলে নেই, ঝাড়া হাত-পা লোক। চাঁপিয়াও তা-ই। এই চুমৌনা হলে দু’জনের পক্ষেই ভাল।

    চাঁপিয়া মুখ নামিয়ে ধানপতকে শুধিয়েছে, ‘চাচা, রিকশা গাড়িয়াটা কি ওর নিজের?’

    চৌপটলাল প্রশ্নের উত্তরটা ধানপতকেই দিয়েছে, ‘ওকে বলে দাও চাচা, ওটা মালিকের। রোজ চার রুপাইয়া তাকে কেরায়া দিতে হয়। তারপর যা থাকে সেটা আমার কামাই।’ একটু থেমে ফের বলেছে, ‘আউর একগো বাত ধানপত চাচা।’

    ধানপত জানতে চেয়েছে, ‘কা বাত?’

    ‘তোমাদের লড়কীকে জানিয়ে দাও’ আমার কামাইয়ের দিকে যেন নজর না দেয়। চুমৌনা হলে নিজের পেটের দানা নিজেকেই ওর জুটিয়ে নিতে হবে। আমার পেটের সওয়াল আমার, ওর পেটের সওয়াল ওর। রাজি হলে এ চুমৌনা হবে।’

    ‘লেকেন তোর ঘরে গিয়ে নয়া জায়গায় চাঁপিয়া নিজের ব্যওস্থা কী করে করবে?’

    ‘সেটা আমি দেখব। রাজি কিনা তুমি ‘পুছে’ নাও—’

    ধানপত উত্তর দেবার আগেই চাঁপিয়া বলে উঠেছে, ‘আমি রাজি।’ আসলে একা একা থাকতে তার সাহস হচ্ছিল না; একটি পুরুখের আশ্রয় তার প্রয়োজন ছিল।

    এবার সোজাসুজি তার দিকে তাকিয়ে চৌপটলাল বলেছে, ‘তা হলে কাল সুবে সাফা কাপড়া-টাপড়া পরে থেক। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব।’

    ধানপত শুধোয়, ‘কোথায় নিয়ে যাবি?’

    চৌপটলাল বলে, ‘সুরথপুরার হাটিয়ায়।’

    ‘সেখানে কী?’

    চৌপটলাল যা উত্তর দেয় তা এই রকম। তখন চাষের মরসুম। চারপাশের দশ-বিশটা গাঁয়ের যত জমির মালিক আছে, তাদের সবার ক্ষেতিমজুর দরকার। সুরথপুরার হাটিয়ায় এ অঞ্চলের তাবৎ ভূমিহীন মেয়েপুরুষ এই সময়টা গিয়ে জড় হয়। জমির মালিকেরা তাদের ভেতর থেকে শক্তসমর্থ দেখে মজুর বেছে নিয়ে যায়। তেমন তেমন খাটিয়ে হলে মালিকের কাছে সালভর কাজ পাওয়া যায়। কাজের বদলে মেলে চাল, গেঁহু বা বজরা আর নগদ কিছু পাইসা। চাঁপিয়াকে যদি পসন্দ করে কোনও জমির মালিক কাজ দেয়, চৌপটলাল তাকে নিজের ঘরে নিয়ে তুলবে।

    ধানপতের সন্দেহ হয়েছিল। সে শুধিয়েছে, ‘তোর মতলব কী রে? চাঁপিয়াকে রাখনি বানিয়ে ঘরে বসাতে চাস?’

    তাড়াতাড়ি জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে চৌপটলাল বলছে, ‘নায় নায় চাচা। ওরকম পাপকা চিন্তা মনে এনো না। তোমাদের লড়কী ক্ষেতিমালিকের কাম পেলেই চুমৌনার ব্যওস্থা করে ফেলব। তারপর ওকে ঘরে নিয়ে যাব। তবে একটা কথা—’

    ‘কা?’

    ‘কাম না পেলে কিন্তু চুমৌনা হবে না। তোমাদের লড়কীকে সুরথপুরার হাটিয়ে থেকে ফিরে আসতে হবে।’

    ধানপতকে বিষণ্ন দেখিয়েছিল। চাঁপিয়ার দিকে ফিরে সে শুধিয়েছে, ‘কা রে রাজি? ভাল করে ভেবে দ্যাখ।’

    চাঁপিয়া বলেছে, ‘ভাবনার কিছু নেই। আমি রাজি।’

    কথামত পরের দিন ভোরে কোয়েলের হাঁটুভর জলে ‘নাহানা’ চুকিয়ে সেজেগুজে গয়না পরে নিজের ঘরে দাওয়ায় বসে থেকেছে চাঁপিয়া। মুঙ্গিলালের সঙ্গে পয়লা সাদির সময় বাপ অনেক চাঁদির গয়না দিয়েছিল। সে সব নিয়ে আসতে পারেনি সে। এক কাপড়ে তাকে মুঙ্গিলালদের গাঁ থেকে পালিয়ে আসতে হয়। পরে অবশ্য বুড়ি পিসীশাশুড়ি তার কাপড়জামা গয়নাগাটি, সব কিছু নিজে এসে দিয়ে গেছে।

    যাই হোক, সুরুয উঠবার আগেই চৌপটলাল এসে চাঁপিয়াকে সঙ্গে করে সুরথপুরার হাটে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে এক ক্ষেতিমালিক তাকে দেখামাত্র পছন্দ করে ফেলে এবং সালভর কাজের ব্যবস্থা পাকা হয়ে যায়।

    চৌপটলাল মরদকা ছৌয়া। তার বাত হাতিকা দাঁত। ঐ হাটিয়াতেই অচ্ছুতিয়াদের বামহন ডেকে চুমৌনা সেরে নয়া বহুকে নিয়ে দুধলিগঞ্জে চলে যায়।

    চৌপটলালের সঙ্গে তার বিবাহিত জীবনের আয়ু মোট চার সাল। এই কটা বছর মোটামুটি ভালই কেটেছে। শর্তানুয়ায়ী চৌপটলাল আর চাঁপিয়া নিজের নিজের পেটের দানা যোগাড় করত। তাদের জীবনে কোনরকম ওঠানামা ছিল না। রোজ ভোরে উঠে বাসি রোটি কি পানিভাত্তা (পান্তাভাত) খেয়ে চুলা ধরিয়ে কালোয়া (দুপুরের খাবার) বানিয়ে নিত চাঁপিয়া। দুটো তোবড়ান সিলভারের কটোরায় কালোয়া ভরে একটা দিত চৌপটলালকে, একটা নিত নিজে। তারপর দু’জনে চলে যেত দু’দিকে। চাঁপিয়া মালিকের খামারে কিংবা ক্ষেতিতে। চৌপটলাল যেত সাইকেল রিকশা নিয়ে পাক্কীতে। সারা দিন পর রাত্রিবেলা দু’জনের দেখা হত। গরম গরম মাড়ভাত্তা বা লিট্টি বানিয়ে খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে ঘন হয়ে পাশাপাশি শুয়ে ঘরের ফুটো ছাউনির ফাঁক দিয়ে আকাশ আর তারার মেলা দেখতে দেখতে কত যে গল্প করত চৌপটলাল।

    চাঁপিয়ার এই চার বছরের বিবাহিত জীবনের একটা বড় ঘটনা হল এক মরা বাচ্চার জন্মদান। এটুকু বাদ দিলে মনে হচ্ছিল, দিন এভাবেই কেটে যাবে।

    কিন্তু চার সাল বাদে এদিকে এমন মারাত্মক খরা হয় যে মাইলের পর মাইল সব চাষের জমি টুটেফুটে গেল। না এক ফোঁটা মেঘ, না এক বুঁদি বারিষ। আকাশের চেহারা দেখে এদিকে আদৌ কোনও দিন যে বৃষ্টি নামবে, এমন ভরসা পাওয়া গেল না। জল না হলেও চাষও নেই। ক্ষেতিমালিক জানিয়ে দিল, সে আর চাঁপিয়াকে রাখতে পারবে না।

    কাজটা চলে যাবার পর চৌপটলাল নিরানন্দ মুখে বলেছিল, ‘মনমে বহোত দুখ হচ্ছে। তবু কথাটা তোকে বলতেই হয়।’

    ‘কা?’ ভয়ে ভয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়েছে চাঁপিয়া।

    ‘তুই মনপত্থলে ফিরে যা।’

    ‘ফিরে যাব!’

    ‘হাঁ।’ বিষণ্নভাবে মাথা নেড়েছে চৌপটলাল, ‘তোর কাম নেই, কামাই বন্দ। এই খরার সময় মানুষের পয়সা নেই; কেউ রিকশ গাড়িয়ায় চড়তে চায় না। দিনভর আমার যা কামাই তাতে আমারই চলে না। তুই থাকলে দু’জনেই ভুখা মরে যাব।’

    অগত্যা কাটান-ছাড়ান হয়ে গেল। নিজস্ব জামাকাপড় আর চাঁদির গয়নাগুলো নিয়ে চোখের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে আবার মনপত্থলে ফিরে এল চাঁপিয়া।

    বাপের ঘরটা অনেক দিন ফাঁকা পড়ে ছিল। মানুষজন না থাকায় হাঁটুভর ধুলোবালি আর জঞ্জাল জমে উঠেছিল সেখানে। সাগুয়ান কাঠের খুঁটিতে ঘুণ ধরে এমন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল যে, ঘরটা হুড়মুড় করে যেকোন সময় পড়ে যেতে পারত। জঞ্জাল সাফসুতরো করে, জঙ্গল থেকে কাঠ জুটিয়ে এনে খুঁটিগুলো বদলে নিয়েছিল চাঁপিয়া।

    এরপর একটা বছর বড়ই কষ্টে কেটেছে তার। চৌপটলালদের ওখানেই শুধু খরা হয়নি, মনপত্থলের চারপাশের চল্লিশ পঞ্চাশটা তালুকের তাবৎ জমি রোদে জ্বলে গিয়েছিল। বারিষের অভাবে চাষবাস যখন বন্ধ, তখন চাঁপিয়ার মত মানুষদের কাজও বন্ধ। কাজেই দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতের দু’ধারের জঙ্গলটাই ওদের একমাত্র ভরসা। সেখান থেকে রোজ মহুয়ার গোটা, রামদানা আর সুথনি জোগাড় করে এনে সে সব সেদ্ধ করে খেয়ে কিভাবে যে পুরা একটা সাল কাটিয়ে দিয়েছে তা একমাত্র চাঁপিয়াই জানে। তার জীবনশক্তি যে প্রবল, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। নইলে এই সব কচুঘেঁচু আগাছা খেয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে!

    এক বছর বাদে আকাশের দেওতা মুখ তুলে চাইল। জেঠ মাহিনা শেষ হতে না হতেই চারপাশ ঘন কাল মেঘে ছেয়ে গেল। চাঁপিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে মাথায় ঠেকিয়েছে আর বলেছে, ‘হে রামজি, হো কিষুণজি, তেরে কিরপা। কাম মিললে ভাত খেতে পাব। এক সাল ভাতের মুখ দেখি না।’

    চাঁপিয়া ঠিক করে ফেলেছিল, দু-এক রোজের ভেতর সুরথপুরার হাটে গিয়ে সেই কড়াইয়া গাছগুলোর তলায় বসবে। ওখান থেকেই চারপাশের ক্ষেতি মালিকেরা মরসুমি কিষাণ জুটিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু যেদিন সে হাটে যাবে তার আগের দিন পাশের গাঁ হাতিয়াড়া থেকে জগন দোসাদ এসে হাজির। সুরথপুরার হাটে ধানচালের আড়তে সে মাল বয়। জগন বলেছিল, ‘হামনি শুনা হ্যায়, তুহারকা ঘরমে মরদ নেহী। চৌপটলালের সাথ তোর সাদি টুটে গেছে।’

    জগন দোসাদকে ছোটবেলা থেকেই চিনত চাঁপিয়া। বাপ বেঁচে থাকতে প্রায়ই মনপত্থলে আসত সে। চাঁপিয়া ঘাড় কাত করে জানিয়েছিল, ‘হ্যাঁ।’

    ‘আমার ঘরেও জেনানা নেই। তোর মন হলে আমার ঘরে আসতে পারিস। মগর—’

    জগন দোসাদের প্রস্তাবটি বুঝতে অসুবিধা হয় না চাঁপিয়ার। একটা তাগড়া তাকতওয়ালা জোয়ান মরদ যেচে এসে তাকে বিয়ের কথা বলছে শুনেও বুকের ভেতরটা উথালপাথল হয়ে ওঠে না। শান্ত চোখে জগনের দিকে তাকিয়ে নিরুত্তাপ গলায় সে শুধিয়েছে, ‘মগর কা?’

    জগন এবার যা বলেছে তা এই রকম। চাঁপিয়াকে সে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পারে একটিমাত্র শর্তে। কামাই করে নিজের পেটের দানা তাকে জোটাতে হবে।

    এমন শর্ত চাঁপিয়ার অজানা নয়। এই কড়ারেই আগের বিয়েটা হয়েছে তার। সে বলেছে, ‘ঠিক হ্যায়।’ এ দেশের নিয়ম এবং সংস্কার অনুযায়ী চাঁপিয়া বুঝে নিয়েছে, সব ঔরতের জন্যই একটা করে পুরুখের প্রয়োজন। সে খেতে পরতে না দিক, অন্য নিরাপত্তার জন্যও তাকে একান্ত দরকার। মেয়েদের পক্ষে একা বেওয়ারিশ পড়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক।

    জগন এবার খুশি হয়ে বলেছে, ‘এহি সাল আসমানে ঘটা দেখে ক্ষেতিমালিকেরা সুরথপুরার হাটিয়ায় কিষাণ নিতে আসছে। ওখানে গেলেই কাম জুটে যাবে।’

    ‘জানি। আমি কাল সুরথপুরা যাব।’

    জগনের উৎসাহ এবার দশ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। সে বলেছে, ‘কাল সুবে তোর এখানে চলে আসব। হামনিলোগন একসাথ সুরুথপুরায় চলে যাব।’

    ‘ঠিক হ্যায়।’

    ‘তোর কাম জুটলে তোকে আমরা ঘরে নিয়ে যাব।’

    পরের দিন ভোরে সুরয উঠবার আগে মনপত্থলের তাবৎ মানুষ দেখল চাঁপিয়া আরও একবার সেজেগুজে হাতিয়াড়া গাঁয়ের জগন দোসাদের পিছু পিছু সুরথপুরার হাটে চলেছে।

    কড়াইয়া গাছের তলায় গিয়ে বসতে না বসতেই কাজ জুটে গিয়েছিল চাঁপিয়ার। ফলে চৌপটলাল যা যা করেছে এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। জগন কোত্থেকে এক টিকিওলা পণ্ডিত ধরে এনে নগদ পাঁচ টাকা দক্ষিণা দিয়ে বিয়েটা চুকিয়ে ফেলে। তারপর চাঁপিয়াকে নিয়ে সিধা নিজের ঘরে চলে যায়।

    চাঁপিয়ার এই তিন নম্বর বিয়ের আয়ু পুরো দুই সালও নয়। পয়লা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পেটে ছৌয়া এসে গেল। কিন্তু সে জন্য কাজ বন্ধ করা যায় না। নায় কাম তো নায় খোরাকি। কাজেই ন’ মাস পর্যন্ত বাচ্চা পেটে নিয়ে মালিকের ক্ষেতিতে কাজ করে গিয়েছিল চাঁপিয়া। তাতে যা হবার তাই হয়েছে। একদিন মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল সে। রক্তাক্ত বেহুঁশ চাঁপিয়াকে একটা গৈয়া গাড়িতে তুলে বিশ মাইল তফাতের এক টৌনে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তিন মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে যখন সে বেরুল, শরীর বেজায় কমজোরি হয়ে গেছে। পেটের ছৌয়াটা তো আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের ডাগদরসাব জানিয়ে দিয়েছে, তার আর ছৌয়া হবে না। সে জন্য খুব একটা দুর্ভাবনা ছিল না। চাঁপিয়ার ভয় তার শরীরটাকে নিয়ে। এই শরীর যদি একবার ভেঙে পড়ে, কাজকর্মের অযোগ্য হয়ে যায়, ভুখা মরে যেতে হবে।

    হাসপাতাল থেকে বেরুবার পর সত্যি সত্যি বড় দুব্‌লা হয়েছিল চাঁপিয়া। ক্ষেতির কাজ তো দূরের কথা, একসঙ্গে দশ পা চলতে তার হাঁফ ধরে যেত। ফলে জমির কাজটা তার গেল। আর যে ঔরত নিজের পেটের দানা জুটিয়ে নিতে পারে না, তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবার মত শৌখিন লোক জগন নয়। কাজেই চাঁপিয়ার তিন নম্বর বিয়েটাও টিকল না। নিজস্ব কাপড়জামা এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে আবার মনপত্থলে ফিরে এল সে।

    এরপর আরও তিনবার সেজেগুজে তিনজনের পিছু পিছু সুরথপুরার হাটিয়ায় গেছে চাঁপিয়া—সেই একই শর্তে। অর্থাৎ ক্ষেতির কাজ পেয়ে পেটের দানা জোটাতে পারলে তবেই সাদি হবে। কিন্তু তার চার-পাঁচ-ছ’ নম্বর বিয়েও বেশি দিন টেকেনি। কোনটা চার সাল, কোনটা বা এক সাল। চার নম্বর বিয়েটা ভাঙল দক্ষিণ কোয়েলের বাঁড়ের জন্য। বন্যায় চাষের জমি ডুবে যাওয়ায় ক্ষেতিমালিক কাজ থেকে তাকে ছাড়িয়ে দেয়। সুতরাং বিয়েও বরবাদ। পাঁচ নম্বর বিয়েটা চৌপট হল মরদ মরে যেতে। ছ’ নম্বর বিয়ে ভাঙল অজন্মার জন্য।

    তারপর এই পড়তি বয়সে চেচকে-ভোগা অশক্ত দুর্বল শরীরে জীবনের সাত নম্বর মরদ নাটোয়ারের সঙ্গে সুরথপুরায় চলেছে চাঁপিয়া।

     

    আচমকা পাশ থেকে নাটোয়ারের গলা কানে আসে, ‘এ ঔরত—’

    এতক্ষণ দূরমনস্কর মত হেঁটে যাচ্ছিল চাঁপিয়া। চমকে সে ঘাড় ফেরায়। বলে, ‘কা?’

    ‘সাফ সাফ দো-চারগো বাত তুহারকা সাথ হয়ে যাক।’

    চাঁপিয়া উত্তর দেয় না। তবে কান খাড়া করে অপেক্ষা করতে থাকে।

    এদিকে ঝাঁ-ঝাঁ করে জেঠ মাহিনার বেলা চড়ে যাচ্ছে। রোদের ঝাঁজ দ্রুত চড়তে থাকে। বাস-ট্রাক, সাইকেল-রিকশা, গৈয়া এবং ভৈসা গাড়ির চলাচলও অনেক বেড়ে গেছে। হাইওয়েতে লাল ধুলো উড়িয়ে চাঁপিয়াদের পাশ দিয়ে সেগুলো একের পর এক বেরিয়ে যেতে থাকে। এখন রাস্তায় মানুষজনও প্রচুর।

    নাটোয়ার বলে, ‘আমার পেটে একেবারে দশগো জানবরের খিদে।’

    চাঁপিয়া অবাক হয় না। নাটোয়ারের আগে যে ক’জনের সঙ্গে সে সুরথপুরার হাটিয়ায় গেছে তারা প্রায় সবাই এ কথা বলেছে। পেটে জানোয়ারের খিদে নিয়ে সবাই তাকে সাদি করতে আসে। যাই হোক চাঁপিয়া কিছু বলে না।

    তীক্ষ্ন চোখে নাটোয়ার এবার চাঁপিয়ার দিকে তাকায়। তার কথা ঔরতটার কানে ঠিক ঠিক ঢুকেছে কিনা, সে সম্বন্ধে কিছুটা সন্দেহ হয়। সে শুধোয়, ‘শুনা হামনিকো বাত?’

    নিচু গলায় চাঁপিয়া বলে, ‘শুনা হ্যায়।’

    ‘আমার যা কামাই তাতে আমার পেটটাই শুধু চলে। সুরথপুরায় গিয়ে কাম তোকে জোটাতেই হবে।’ নাটোয়ার শেষ কথাগুলোর ওপর যথেষ্ট জোর দেয়।

    এ জাতীয় কথাও চাঁপিয়ার কাছে নতুন কিছু নয়। শান্ত মুখে সে বলে, ‘জানি।’

    এবার ডান হাতের আঙুল নেড়ে উথলে-ওঠা স্বরে নাটোয়ার বলে, ‘তব্ হাঁ—’

    ঈষৎ কৌতূহল নিয়ে চাঁপিয়া সঙ্গীর দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে, ‘কা?’

    ‘তোর কামটা হয়ে গেলে একটা সাদির মত সাদি করব। সবাই একেবারে তাজ্জব বনে যাবে।’

    এই বয়সে জীবনের সাত নম্বর সাদিতে কতটা ঘটা হওয়া সম্ভব, চাঁপিয়া ভেবে পায় না। তবু নাটোয়ারের এই উচ্ছ্বাস একেবারে মন্দ লাগে না। বুকের ভেতর ঠাণ্ডা ঝিমান রক্ত একটু যেন ছলকেই ওঠে তার।

    হাঁটতে হাঁটতে চাঁপিয়ার কাপড়চোপড় লক্ষ্য করে নাটোয়ার। শাড়ি আর জামা যদিও পরিষ্কার, তবে বহুকালের পুরানো। নানা জায়গায় পিঁজে পিঁজে গেছে; দু-চারটে তালিও চোখে পড়ে। নাটোয়ার জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, ‘নায় নায়, এহী কাপড়াউপড়া চলবে না। সুরথপুরায় গিয়ে দুকান থেকে এ্যায়সা জগমগ জগমগ কাপড়া আউর জামা কিনে দেব যে লোকের আঁখ ধাঁধিয়ে যাবে—হাঁ!’

    আগে আর এ জাতীয় কথা কেউ কখনও বলেনি। আশায় সুখে এবং উত্তেজনায় চাঁপিয়ার বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। নাটোয়ার তার উত্তেজনাটা আরেকটু উসকে দেয়। সে ফের বলে, ‘বিলাইতি পাউডেল (পাউডার), সিনুর (সিঁদুর), খসবুদার তেল ভি কিনে দেব। আর কী কী দেব জানিস?’

    ‘কা?’

    চাঁদির বিছুয়া, করণফুল, পৈড়ী, কজরৌটি—’

    বাধা দিয়ে মৃদু গলায় চাঁপিয়া বলে, ‘আমার তো এসব আছে। আবার নতুন করে—’

    হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিতে দিতে নাটোয়ার বলে, ‘তুই আমার ঘরে নয়া যাচ্ছিস। তোকে কিছু দিতে আমার ইচ্ছা করে না? হাঁ কি নায়—বাতা, বাতা—’

    চোখ নামিয়ে চাঁপিয়া বলে, ‘হাঁ।’

    ‘তোকে নাজুক সুনহলা দুলহানিয়া বানিয়ে ঘর নিয়ে তুলব। বিলকুল পরী য্যায়সা—’

    চড়া রঙে চাঁপিয়ার চোখের সামনে ঝকমকানো স্বপ্নের একটি ছবি আঁকতে আঁকতে নাটোয়ার তাকে নিয়ে একসময় সুরথপুরায় পৌঁছে যায়।

     

    সুরথপুরা হাটের দক্ষিণ দিক ঘেঁষে যে বার চোদ্দটা কড়াইয়া গাছ গা-জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে তার তলায় বরাবর যেমন হয়, এবারও তেমনি মরসুমী ভূমিহীন ক্ষেতমজুররা জমা হয়েছে। তা পুরুষ এবং ঔরত মিলিয়ে দু-আড়াই শ লোক তো হবেই। মেয়েমানুষগুলোর বেশির ভাগেরই কোলে দু-একটা বাচ্চা ঝুলছে।

    নাটোয়ার আর চাঁপিয়া সিধা সেখানে চলে আসে। ক্ষেতমজুরদের জটলাটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে নাটোয়ার বলে, ‘তুই ওখানে গিয়ে বোস।’

    চাঁপিয়া শুধোয়, ‘তুমি?’

    নাটোয়ার বলে, ‘আমি আর বসব না। দুকান থেকে চায়-পানি খেয়ে আসি।’ তারপর আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘ডর নেই, একাই খাব না। তোর জন্যও নিয়ে আসব।’

    নাটোয়ার দাঁড়ায় না। হাটের যে দিকটা দোকানপাট দিয়ে সাজান এবং মানুষের ভিড়ে জমজমাট সিধা সেখানে চলে যায়। আর আস্তে আস্তে চাঁপিয়া ক্ষেতমজুরদের পাশে গিয়ে বসে।

    তার চারপাশে যারা আছে তাদের প্রায় সবাইকেই চেনে চাঁপিয়া। এদের কেউ দোসাদ, কেউ গঞ্জু, কেউ তাতমা, কেউ ধোবি, কেউ মুসহর। মোট কথা জাতপাতের দিক থেকে পুরোপুরি অচ্ছুৎ। এই জল-অচলরা ছাড়াও আর যারা আছে তারা হল আদিবাসী মুণ্ডা, ওঁরাও, সাঁওতাল ইত্যাদি ইত্যাদি।

    হাটের এই অংশটা ফাঁকা ফাঁকা, লোকজনের ভিড় কম। আসল হাট হল খানিকটা তফাতে—উত্তর দিকটায়। সেখান থেকে ভনভনে মাছির মত একটানা আওয়াজ আসছে।

    আবছাভাবে নিজের চারপাশের ক্ষেতমজুরের দিকে একবার তাকায় চাঁপিয়া। পরক্ষণেই তার নজর গিয়ে পড়ে সামনের চালাঘরগুলোর তলায়। হাটের চালা হলেও ওখানে আজকাল দোকান টোকান বসে না; ওগুলো বাতিল করে হাটটা দূরে সরে গেছে।

    পরিত্যক্ত চালাগুলোর তলায় এই মুহূর্তে এ অঞ্চলের ক্ষেতমালিক এবং তাদের লোকজনেরা বসে আছে। বোঝা যায়, এখনও মজুর বাছাবাছি শুরু হয়নি।

    দুব্‌লা শরীরে মনপত্থল থেকে এতটা হেঁটে আসার জন্য হাত-পা যেন ভেঙে আসছিল চাঁপিয়ার। তার ওপর এখন পর্যন্ত পেটে কিছুই পড়েনি। ক্ষ্যাপা জন্তুর মত খিদেটা ধারাল দাঁতে পাকস্থলীটা যেন ক্রমাগত ফেঁড়ে ফেঁড়ে দিচ্ছে। নাটোয়ার অবশ্য ভরসা দিয়েছে, তার জন্য চায়-পানি নিয়ে আসবে। দেখাই যাক।

    ক্ষেতমজুররা এধারে ওধারে কথা বলে যাচ্ছে। বাচ্চাকাচ্চাগুলো কেউ চিল্লাছে, কেউ লাল ধুলো মেখে হুটোপাটি করছে। চাঁপিয়া কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছে না। এখন তার একটাই চিন্তা। যেভাবেই হোক, ক্ষেতির কাজ তাকে পেতেই হবে। মনে মনে বিড়বিড়িয়ে সে অনবরত বলতে থাকে, ‘হো রামজি, হো কিষুণজি, অব তেরে কিরপা।’

    আচমকা পেছন থেকে কে যেন ডেকে ওঠে, ‘কৌন—চাঁপিয়া?’

    ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় চাঁপিয়া। হাত দশেক ফারাকে বসে আছে আটবুড়ো গৈবীনাথ। তাকে দেখামাত্র চমকে ওঠে চাঁপিয়া। চেহারার এ কী হাল করেছে লোকটা।

    এখন থেকে অনেক সাল আগে প্রথম যেবার কাজের আশায় এই কড়াইয়া গাছগুলোর তলায় এসে চাঁপিয়া বসেছিল সেই তখন থেকেই গৈবীনাথকে চেনে সে। তারপর যতবার এখানে এসেছে ততবারই লোকটাকে দেখেছে। পাথর কি লোহা দিয়ে তৈরি ছিল তার শরীর। গায়ে ছিল দশটা বনভয়সার তাকত। ওকে দেখামাত্র জমি মালিকদের পছন্দ হয়ে যেত।

    গৈবীনাথ জাতে ধোবি। অনেক সাল ধরে দেখাশোনার ফলে তার সঙ্গে খানিকটা ঘনিষ্ঠতাই হয়েছে চাঁপিয়ার। অন্য ক্ষেতমজুররা যখন নিজের নিজের ধান্দা ছাড়া আর কিছু বোঝে না, তখন গৈবীনাথের সঙ্গে দেখা হলেই সে তার খোঁজখবর করেছে; নতুন নতুন মরদদের কথা জানতে চেয়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একের পর এক বিয়ে ভাঙার কারণগুলো জেনে আন্তরিক দুঃখ এবং সহানুভূতি জানিয়েছে। লোকটা এককথায় খুবই বড়মাপের দিলওয়ালা আদমী।

    মাঝখানে তিন সাল সুরথপুরায় আসতে পারেনি চাঁপিয়া। এর ভেতর লোহা বা পাথরে বানান গৈবীনাথের চেহারাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে যেন। গাল তুবড়ে চোয়ালের হাড় ফুটে বেরিয়েছে। গায়ে মাংস বলতে কিছুই নেই। পাঁজরাগুলো গুনে নেওয়া যায়। দেহের ঐ বিশাল কাঠামোটায় এখন শুধু হাড্ডি আর হাড্ডি। চোখ দুটো এক আঙুল করে গর্তে ঢুকে গেছে। চামড়া ঢিলে হয়ে কুঁচকে গেছে। থেমে থেমে হাঁ করে একেকবার শ্বাস নেয় সে আর হাঁপায়। দেখেই বোঝা যায়, ফুসফুসের সঙ্গে বাইরের বাতাসের যোগাযোগ রাখতে ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে গৈবীনাথের। অথচ কী এমন বয়েস! বড়জোর পঁচাশ কী তার চাইতে দু-এক সাল বেশি। কিন্তু এখন গৈবীনাথকে দেখে মনে হয় বয়েসটা সত্তর কী আশী পেরিয়ে গেছে।

    চাঁপিয়া বলে, ‘তুম!’

    ‘হ্যাঁ রে—’ গৈবীনাথ এগিয়ে এসে তার পাশে বসে।

    ‘এ কী চেহারা করেছ!’

    ‘কা করে! তিন চার সাল ধরে বুকের দোষ হয়েছে। তার সাথ সাথ হাঁপ আউর খাঁসি (কাশি)। তাতেই শরীরটা চৌপট হয়ে গেল।’

    ‘ডাগদর দেখিয়ে দাওয়া খেয়েছ?

    ‘পেটের দানা জোটে না তো ডাগদর, দাওয়া। আমাকে কী পেয়েছিস—রাজা মহারাজাকা ছৌয়া?’

    চাঁপিয়া আর কিছু বলে না।

    গৈবীনাথ এতক্ষণ ভাল করে লক্ষ্য করেনি। এবার জেল্লাহীন ঘোলাটে চোখে একদৃষ্টে চাঁপিয়াকে দেখতে দেখতে বলে, তুইও চেহারার কী হাল করেছিস!’

    চাঁপিয়া বড় করে শ্বাস ফেলে। বলে, ‘চেচক (বসন্ত) হল যে। তারপরই হাল বুরা হয়ে গেল।’

    ‘তুই আমি, দু’জনেই বুখারে কমজোরি হয়ে গেছি। ক্ষেতির কাম মিলবে কি না কে জানে।’

    ‘ভগোয়ান কিষুণজিকা কিরপা—’

    এই সময় মাটির খোরায় চা, গরম গরম সমোসা এবং পাঁউরুটি নিয়ে ফিরে আসে নাটোয়ার। রুটি-টুপি চাঁপিয়ার হাতে দিতে দিতে বলে, ‘গরমাগরম খা লে। আমি আবার হাঁটিয়ায় যাচ্ছি।’

    ‘কায়?’ নিজের অজান্তেই চাঁপিয়ার মুখে থেকে কথাটা বেরিয়ে আসে যেন।

    ‘পাক্কী ধরে আসতে আসতে বললাম না, নয়া জগমগ-জগমগ কাপড়া-উপড়া কিনে দেব। আমার মরদকা জবান—হাঁ’ বলে আর দাঁড়ায় না নাটোয়ার; ফের হাটের ভিড়ে মিশে যায়।

    চায়ের ভাঁড়ে মুখ ঠেকাতে গিয়ে হঠাৎ চাঁপিয়ার চোখে পড়ে লুব্ধ দৃষ্টিতে খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে গৈবীনাথ আর সমানে ঢোক গিলছে। বোঝা যায় লোকটার পেটে এই মুহূর্তে মারাত্মক ভুখ। চাঁপিয়া শুধোয়, ‘চায়-পানি খাবে?’

    গৈবীনাথ উত্তর দেয় না তবে তার মুখচোখ দেখে মনে হয়, খাবার ষোল আনা ইচ্ছে।

    ভাঁড়সুদ্ধ পুরো চা’টা দেবার মত অতখানি মহানুভবতা চাঁপিয়ার অন্তত নেই। আলগোছে অর্ধেকটা চা খেয়ে বাকি ভাঁড়টা গৈবীনাথকে দেয় সে। সেই সঙ্গে সমোসা পাঁউরুটির ভাগও।

    চায়ে ভিজিয়ে গোগ্রাসে খেতে খেতে গৈবীনাথ শুধোয়, ‘ঐ আদমীটা কে?’

    ‘কার কথা বলছ,’ চাঁপিয়া জানতে চায়।

    ‘যে চায়-পানি আউর রোটি উটি দিয়ে গেল।’

    ‘ওর নাম নাটোয়ার দুসাদ।’

    কৌতূহলী চোখে চাঁপিয়ার দিকে তাকিয়ে গৈবীনাথ এবার জিজ্ঞেস করে, ‘নাটোয়ার তোকে চায় রোটি খিলাচ্ছে কেন?’

    চাঁপিয়া চুপ করে থাকে।

    গৈবীনাথ এবার বলে, ‘সমঝ গিয়া কাম মিললে নাটোয়ার তোকে সাদি করে নিয়ে যাবে—নায়?’

    চাঁপিয়া মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।

    গৈবীনাথ ফের বলে, আগে তো তোর ছে ছে’গো (ছ ছ’টা) সাদি হয়ে গেছে।’

    চাঁপিয়া সম্পর্কে সব খবরই রাখে গৈবীনাথ। চাঁপিয়া বলে, ‘হাঁ।’

    ওদের কথাবার্তার মধ্যেই নাটোয়ার আবার ফিরে আসে। তার হাতে জগমগ-জগমগ নতুন শাড়ি। চাঁপিয়াকে সেটা দিতে দিতে বলে, ‘কাছে রাখ। আমি তোর সপরনার (সাজগোজের) জিনিসগুলো নিয়ে আসি।’ বলেই সে চলে যায়।

    একসময় সামনের চালাগুলোর তলা থেকে ক্ষেতিমালিক এবং তাদের লোকজন উঠে এসে কিষাণ বাছতে শুরু করে। গৈয়াহাটা, ছাগরিহাটা কি মুরগিহাটায় যেভাবে গরুবাছুর ছাগল বা মুরগির গা টিপে টিপে পরখ করে নেওয়া হয় অবিকল সেই ভাবেই কড়াইয়া গাছগুলোর তলায় ঘুরে ঘুরে তারা ভূমিহীন ওঁরাও-মুণ্ডা এবং অচ্ছুৎদের যাচিয়ে বাজিয়ে নিচ্ছে। ক্ষেতি চষার মত মারাত্মক খাটুনির কাজের তাকত যাদের আছে জমিমালিকেরা শুধু তাদেরই বেছে নিচ্ছে। দুর্বল অশক্ত লোক নিয়ে কী লাভ?

    হট্টাকাট্টা চেহারার পুরুষ আর ঔরতেরা প্রথমেই কাজ পেয়ে যায়। ওদের নিয়ে কিছু কিছু জমিমালিক চলে যেতে থাকে। কড়াইয়া গাছগুলোর তলা ক্রমশ ফাঁকা হয়ে আসে।

    ঝড়তি পড়তি পঞ্চাশ ষাটটা আদিবাসী আর অচ্ছুৎ ধোবি দোসাদের ভেতর চাঁপিয়া এখনও বসে আছে। তার পাশে গৈবীনাথ। লোকটা সমানে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। জলহীন ফাঁক হুকো টানার মত অদ্ভুত একটা শব্দ একটানা কানে ঢুকতে থাকে চাঁপিয়ার।

    অন্য সব বছর দেখামাত্রই জমিমালিকরা চাঁপিয়াকে পছন্দ করে ফেলত। কিন্তু এবার বরাত খারাপ। কিষাণ বাছাবাছি শুরু হবার পর কত ক্ষেতিমালিক তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এক পলক তাকে দেখেই চলে গেছে। গৈবীনাথেরও সেই একই হাল।

    তবু আশা একেবারে ছেড়ে দেয়নি চাঁপিয়া। এখনও জনকয়েক ক্ষেতিমালিক রয়েছে। এই চাষের মরসুমে প্রচুর কিষাণ দরকার। নিশ্চয়ই কেউ না, কেউ তাকে কাজ দেবে। মনে মনে অনবরত চাঁপিয়া বিড় বিড় করতে থাকে। ‘হো কিষুণজি, হো রামজি তেরে কিরপা।’

    জেঠ মাহিনার সূর্য এখন খাড়া মাথার ওপর উঠে এসেছে। চারদিকে ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ।

    যে ক’জন জমিমালিক এখনও রয়েছে তারা কড়াইয়া গাছগুলোর তলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে যেই কেউ কাছে এসে দাঁড়ায়, বুকের ভেতর শ্বাস আটকে আসে চাঁপিয়ার। বেশির ভাগই কিছু না বলে সরে যায়। তবে এক আধজন জিজ্ঞেস করে, ‘কা রে, ক্ষেতির কাজ পারবি?’

    রুদ্ধশ্বাসে চাঁপিয়া উত্তর দেয়, ‘পারব হুজৌর।’

    তীক্ষ্ন চোখে জমিমালিক লক্ষ্য করতে থাকে। চাঁপিয়া সারা গায়ে শাড়ি জড়িয়ে জড়সড় হয়ে আছে। জমিমালিক বলে, ‘কাপড়া হটা—’

    শাড়ি সরালে আসল চেহারা বেরিয়ে পড়বে। এমনিতেও যেটুকু আশা আছে, শরীরের হাল দেখলে কেউ তাকে পছন্দ করবে না। সে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘নায় নায় হুজৌর—’

    জমিমালিক ভাবে, লজ্জায় ও সঙ্কোচে চাঁপিয়া গা থেকে কাপড় সরাতে চাইছে না। কুৎসিত একটা খিস্তি ঝেড়ে সে বলে, ‘রাজা মহারাজের বিটিয়া সব—’ বলেই এক টানে শাড়ির খানিকটা খুলে ফেলতেই চাঁপিয়ার দুর্বল রোগা শরীরের অনেকটা দেখতে পায়! বলে, ‘ইসে লিয়ে কাপড়া জড়িয়ে আছিস।’ তারপর আঙুল দিয়ে চাঁপিয়ার হাত টিপতে টিপতে বলে, ‘তোর গায়ে তো কিছু নেই রে। তোকে দিয়ে চলবে না।’

    জমিমালিকের দু’পা জড়িয়ে ধরে চাঁপিয়া ‘চলবে হুজৌর। আমাকে কাম দিয়ে দেখুন—’

    ‘হট্ হট্—’ অকারণে বেশি কথা বলা প্রয়োজন বোধ করে না জমিমালিক। এক ঝটকায় পা ছাড়িয়ে নিয়ে সে এগিয়ে যায়।

    এবার গৈবীনাথ পাশ থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হামনিকো লে যা হুজৌর।’

    জমিমালিক থমকে দাঁড়িয়ে যায়। বলে, ‘তোর সিনা (বুক) তো চুহার মত। মর্দাকে (মড়া) দিয়ে কি চাষের কাম হয়? ভাগ শালে ভূচ্চর—’

    গৈবীনাথ এবং চাঁপিয়া হাতেপায়ে ধরে হাজার কাকুতি মিনতি করেও একজন জমিমালিককেও টলাতে পারে না। বিশ পঁচিশ সাল ধরে সুরথপুরার হাটিয়ায় এই কড়াইয়া গাছগুলোর তলায় এসে বসছে দু’জনে। যত বার এসেছে তত বারই তাদের ক্ষেতির কাজে নেবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে। শুধু এবারই বাদ।

    সূর্য যখন পচিমা আকাশে হেলে পড়তে থাকে সেই সময় ঝড়তি পড়তিদের ভেতর থেকে আরও কিছু ঔরত ও পুরুষ কিষাণ বেছে নিয়ে বাকি জমিমালিকেরা চলে যায়। যে বিশ-পঁচিশটা আদিবাসী এবং অচ্ছুৎ চাঁপিয়াদের সঙ্গে বাতিল হয়ে গেছে তারাও একজন দু’জন করে চলে যায়। কড়াইয়া গাছগুলোর তলায় শুধু থাকে দু’জন—চাঁপিয়া আর গৈবীনাথ।

    দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে এখন চুপচাপ বসে আছে চাঁপিয়া। তার পাশে শ্বাসটানা অদ্ভুত শব্দে করে কেঁদে চলেছে গৈবীনাথ, ‘কাম নায় মিলল। মর যায়েগা, জরুর মর যায়েগা—’  একদিন যার শরীর ছিল লোহা বা পাথর কেটে তৈরি, সে যে এভাবে কাঁদতে পারে, তা যেন ভাবা যায় না। তার কান্নার আওয়াজ জ্যৈষ্ঠের তাতানো বাতাসে ঘন বিষাদ ছড়াতে থাকে।

    ঠিক এই সময় সপরনার জিনিসপত্র কিনে ফিরে আসে নাটোয়ার। কড়াইয়া গাছগুলোর তলায় ফাঁকা জায়গাটায় ঘাড় গুঁজে চুপচাপ চাঁপিয়াকে বসে থাকতে দেখে চোখের পলকে কিছু একটা আঁচ করে নেয়। গৈবীনাথ সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। আস্তে করে নাটোয়ার ডাকে, ‘চাঁপিয়া—’

    চাঁপিয়াও কাঁদছিল; তবে শব্দ করে নয়। নাটোয়ারের গলা কানে আসতেই তার হৃদ্‌পিণ্ড থমকে যায়। মুখ তুলে আরক্ত চোখে ভয়ে ভয়ে নাটোয়ারের দিকে তাকায়।

    নাটোয়ার সরাসরি কাজের কথায় আসে, ‘ক্ষেতিকা কাম মিলল?’

    ‘নায়—’ বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ে চাঁপিয়া।

    ‘এতগুলো ক্ষেতিমালিক এসেছিল; কেউ তোকে পসন্দ করল না?’

    ‘নায়—’

    নাটোয়ারকে দেখে কান্না থামিয়ে দিয়েছিল গৈবীনাথ। কড়াইয়া গাছগুলোর তলায় এই নির্জন দুপুরে গভীর স্তব্ধতা নেমে আসে কিছুক্ষণের জন্য।

    একসময় ঠাণ্ডা গলায় নাটোয়ার শুরু করে, ‘কাম মিলল না। তা হলে সাদিটা হয় কী করে?’

    চাঁপিয়া চুপ।

    কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নাটোয়ার। তারপর ফের বলে, ‘শাড়িটা দে—’

    নিঃশব্দে কাঁপা হাতে নতুন কাপড়টা পাশ থেকে তুলে নাটোয়ারের দিকে বাড়িয়ে দেয় চাঁপিয়া। একরমক ছোঁ মেরেই সেটা নিয়ে হাটের দিকে চলে যায় নাটোয়ার।

    এতক্ষণ বুকের ভেতর দম বন্ধ করে বসে ছিল গৈবীনাথ। এবার বড় করে শ্বাস টানে সে; খানিক হাঁপিয়ে গাঢ় দুঃখের গলায় বলে, ‘তোর এই সাদিটা বরবাদ হয়ে গেল।’

    চাঁপিয়া কিছু বলে না। বলার কী-ই বা থাকতে পারে এই অবস্থায়।

    গৈবীনাথ বলতেই থাকে, ‘এখন কী করবি? কাম তো জুটল না। রও আগ য্যায়সা (আগুনের মত); গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে।’

    সাদি না হওয়া এবং কাজ না পাওয়ার ধাক্কা কিছুটা কাটিয়ে ওঠে চাঁপিয়া। তার মনে হয়, এটাই তো একান্ত স্বাভাবিক। এবার সে মুখ খোলে, ‘এখানে বসে থেকে কা ফায়দা? ঘরে লৌটব।’

    ‘মনপত্থল?’

    ‘হাঁ।’

    ‘সুরথপুরায় এসে এই পয়লা সাদি না করে তুই বাপের ঘরে লৌটছিল—নায়?’

    কথাটা বলার জন্যই বলেছে গৈবীনাথ। উত্তর না দিয়ে চাঁপিয়া বলে, ‘তুমি এখন কী করবে?’

    ‘ভাবছি।’ সাঁই সাঁই শব্দ করে শ্বাস টানতে থাকে গৈবীনাথ, ‘আমার যাবার কোন জায়গা নেই।’

    ‘কেন, তোমার গাঁওকা ঘর?’

    ‘দো সাল আগে ওটা মহাজনের পেটে ঢুকে গেছে।’

    ‘ক্যায়সে?’

    ‘ভারী বীমার (রোগ) হল। কাম বন্ধ্‌, মগর পেটটা তো চালু রাখতে হবে। তাই করজ নিয়েছিলাম। রুপাইয়া ওয়াপস করতে পারলাম না; বাপ-নানার ঘরটা চলে গেল।’

    ‘তাহলে তুমি থাক কোথায়?’

    ‘ইঁহা-উঁহা। হাটিয়ার চালির তলায়, পেঁড়কা নীচামে, সড়ককা বগলমে। বুকের দোষ হয়েছে, গলা দিয়ে খুন নিকলেছিল, কোন মানুষ আমাকে কাছে ভিড়তে দেয় না।’

    হঠাৎ বাতিল, বীমারী রুগ্ণ দুর্বল মানুষটা সম্বন্ধে অপার সহানুভূতি বোধ করতে থাকে চাঁপিয়া। গৈবীনাথের মত সে-ও তো পৃথিবী থেকে খারিজ হয়ে গেছে। চাঁপিয়া বলে, ‘তোমার তা হলে কোথাও যাবার জায়গা নেই?’

    ‘নায়—’ ঘাড় হেলায় গৈবীনাথ।

    ‘হামনিকো সাথ মনপত্থল চল।’

    গৈবীনাথ চমকে ওঠে, ‘কী বলছিস! তোর মাথাটা খারাপ হয়ে গেল!’

    চাঁপিয়া বলে, ‘ঠিকই বলছি। মাথা আমার ঠিকই আছে।’

    ‘তুই একা থাকিস। আমাকে নিয়ে তুললে গাঁওবালারা কী বলবে হুঁশ আছে?’

    এ দিকটা খেয়াল করেনি চাঁপিয়া। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে সে। মনে মনে ভাবে, এতকাল নিজের নিরাপত্তা ছাড়া আর কোনও চিন্তাই তার মাথায় ঢুকত না। এ জন্য একের পর এক পুরুষের পিছু পিছু সুরথপুরার হাটে এসেছে। কিন্তু তার চাইতেও দুর্বল, তার চাইতেও কমজোরী অসহায় বিমারী আদমীও রয়েছে। লক্ষকোটি মানুষের পৃথিবীতে গৈবীনাথকেই একমাত্র তার বড় আপন মনে হয়। চাঁপিয়া মনঃস্থির করে ফেলে। বলে, ‘মনপত্থলে যাবার আগে বামহনের কাছে গিয়ে সাদিটা চুকিয়ে ফেলব। চাঁদির পৈড়ি বেচে বামহনের পাইসা দেব।’

    ফুসফুস ফাটিয়া চিৎকার করে ওঠে গৈবীনাথ, ‘নায় নায়, এ নহি হোগা—’

    চাঁপিয়া বলে, ‘তুমনি চুপ হো যাও। রামজি কসম—’

     

    সন্ধ্যের পর মনপত্থলের দোসাদরা, গঞ্জুরা, ধোবিরা চমকে উঠে দেখতে পায় চাঁপিয়া দুসাদিন ভোরে সেজেগুজে একজনের সঙ্গে চলে গিয়েছিল, কিন্তু ফিরে এল আরেকজনের সঙ্গে।

    এতদিন ছ’ ছ’টা পুরুষ চাঁপিয়াকে সাদি করে নিয়ে গেছে। কিন্তু জীবনে এই প্রথম সে স্বয়ম্বরা হল।

    একসময় সবার অবাক চোখের সামনে দিয়ে দু’টি বাতিল মানুষ মনপত্থলের শেষ মাথায় বহুকালের

    প্রফুল্ল রায়
    প্রফুল্ল রায়
    প্রফুল্ল রায় (১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪) পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান সমসাময়িক লেখক, যিনি ১৯৩৪ সালে প্রাক্তন পূর্ব বাংলার ঢাকা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচনাগুলি শহুরে এবং গ্রামীণ উভয় অবস্থাতেই শক্তিশালী এবং সত্যিকারের বিদ্যমান বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে যা পাঠককে বহুমাত্রিক সামাজিক গোলকধাঁধা আবিষ্কার করতে সাহায্য করে। তিনি উপন্যাস এবং ছোটগল্প সহ প্রায় দেড় শতাধিক বই লিখেছেন। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘পূর্ব পার্বতী’ রচিত হয়েছিল নাগাল্যাণ্ডে।
    Previous article
    Next article

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here
    Captcha verification failed!
    CAPTCHA user score failed. Please contact us!

    ভাঙার গান

      ১  কারার ওই লৌহ-কবাটভেঙে ফেল কর রে লোপাট  রক্তজমাট  শিকল-পুজোর পাষাণবেদি!ওরে ও তরুণ ঈশান!বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ!  ধ্বংসনিশান  উড়ুক প্রাচী-র প্রাচীর ভেদি।  ২  গাজনের বাজনা বাজাকে মালিক? কে সে রাজা?  কে দেয় সাজা  মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?হা হা হা পায় যে...

    নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে

    নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে, হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।বাসনা বসে মন অবিরত, ধায় দশ দিশে পাগলের মতো। স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত জাগিছ...

    স্বাধীনতা তুমি

    স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা- স্বাধীনতা তুমি শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা স্বাধীনতা তুমি পতাকা-শোভিত...

    কেউ কথা রাখেনি

    কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিলো শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে তারপর কত চন্দ্রভুক...

    খোলামকুচি

    সকাল থেকেই ভার হয়ে আছে মেঘ। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের সাপ বিষ ঢেলে দেয় আকাশে। বৃষ্টির তবু দেখা নেই, শুধু তর্জন-গর্জন। বাবুয়া চা-দোকান থেকে বেরিয়ে...

    পাদটীকা

    গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়। পাঠান-মোগল আমলে যে দুর্দৈব ঘটেনি ইংরাজ...

    রস

    কার্তিকের মাঝামাঝি চৌধুরীদের খেজুর বাগান ঝুরতে শুরু করল মোতালেফ। তারপর দিন পনের যেতে না যেতেই নিকা করে নিয়ে এল পাশের বাড়ির রাজেক মৃধার বিধবা...

    লেখক অমনিবাস

    এই বিভাগে