সপ্তাহের সেরা

    আখ্যাত রচনা

    গল্পখোলামকুচি

    খোলামকুচি

    সকাল থেকেই ভার হয়ে আছে মেঘ। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের সাপ বিষ ঢেলে দেয় আকাশে। বৃষ্টির তবু দেখা নেই, শুধু তর্জন-গর্জন। বাবুয়া চা-দোকান থেকে বেরিয়ে এসে পাকা রাস্তার দিকে তাকাল। লালি বলেছিল — ওরা এই পথ দিয়ে যাবে। দু’ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে তবু ওদের দেখা নেই। লালি যে মিথ্যা কথা বলবে এটা স্বপ্নেও ভাবে না বাবুয়া। লালির কী স্বার্থ আছে এতে?  সে তো বাবুয়ার ভাল চায়। সে ছায়াসঙ্গী হতে চায় মা মরা ছেলেটার। কিন্তু বাবুয়ার কোনও সায় নেই এতে। সে গোঁসা করে বলে, আমার কী আছে যে তোকে পালব?  চোখের ছিমুতে মা মরল তাকে আমি ভাল ডাক্তার দেখাতে পারিনি। বাপটা তো কসাই। ওর মুখের দিকে তাকাতে আমার ঘেন্না হয়। লালি তাকে বোঝালেও বোঝে না বাবুয়া। সে যেন একগুঁয়ে মাটি জুড়ে বসে থাকা পাথরের চাটান। তার দু’চোখের তারায় জ্বলজ্বল করছে ক্রোধ—আগুন। সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সে খাক করে দিতে চায়।

    লালির মুখ থেকে কথাটা শোনার পর থেকে বাবুয়ার আর মাথার ঠিক নেই। দুপুরে সে ভাত খেল না। দশরথ তাকে কত বোঝাল তবু সে ঠেলে ফেলে দিল ভাতের থালা। দু’চোখে আগুন উগরে শুধোল, বল, মাকে তুমি কোথায় পুঁতেছ? তোমাকে বলতেই হবে।

    ঝড়জলের দিন মারা গেল মায়া অথচ তার মরার বয়স হয়নি। টিবিটা আজকাল কোনও রোগ নয় তবু তাকে অবহেলায় চলে যেতে হল! দশরথ তাকে দু’চোখে দেখতে পারত না। ফি-কথায় বলত, খেটে খা, আমার পয়সা তো খোলামকুচি নয়।

    খাটতে পারত না মায়া তবু দু’ঘরে কাজ নিয়েছিল সে। বাসন মেজে, জল ঘেঁটে হাতে পায়ে হাজা। মাস গেলে যা পেত তাও বন্ধ হয়ে গেল রোগটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরে। তখনও দশরথের মনে কোনও দয়ার চোরা স্রোত নেই। সে পাথর মানুষ, তার বুকে একটাও লোম নেই। মায়া কাঁদত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, তার কান্না বোলতার হুল ঢুকিয়ে দিত বাবুয়ার কানে। পড়ায় মন বসত না তার। মাধ্যমিক ভাল ভাবে পাশ করলেও বার ক্লাসে সে যে চিপকে যাবে এটা সে আগেভাগেই জানত। তবু লালি তাকে বোঝাত, পড়ছ না কেন? তোমার মাথা আছে, মন দিয়ে পড়। আমাদের জাতে কেউ পড়ালেখা শেখে না, তুমি তো আমাদের গর্ব। কালির আঁচড় যে মনে একবার লেগেছে, সে মন সহজে ভাঙে না। বই খুললেই বাবুয়ার চোখে ভাসত মায়ের কাতর মুখখানা। অথচ দশরথ দিব্যি চলে যেত বিন্দুর ঘরে। ওখানে প্রায়ই বসত মদের আসর। গঙ্গা পেরিয়ে মহাজন আসত সদর হাসপাতালের কোয়ার্টারে। দশরথ ফিসফিস করে কথা বলত তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে। থোকা থোকা নাম্বারি নোট দিত দাড়িওয়ালা জুগনু মহাজন। বিন্দুর তখন অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়ে না। দশরথকে নিয়ে সে লুকিয়ে চলে যেত গাং-ধারের সিনেমায়। ঘরে অসুখে কোঁকাত মায়া। তার বুকের রোগের পথ্য জুটত না। পাশের ঘরে থাকত লালির বাবা বৃন্দাবন। সে মাঝে মাঝে মেয়ের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিত ভাল মন্দ খাবার। মায়া খেত আর কাঁদত। বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছাটা প্রকাশ পেত তার দু’চোখের তারায়।

    বাবুয়া এ সব চোখের সামনে দেখেছে। টাটকা ফুল কীভাবে অনাদরে ঝরে যায়—এ দৃশ্য সে জীবনে কোনও দিন ভুলবে না। মানুষের জীবন যে খোলামকুচির চাইতে মূল্যহীন—এই বোধ এবং বিশ্বাস তাকে কুরেকুরে খায়। তাই লালি কথাটা বলার পর থেকে তার মাথার কোনও ঠিক নেই। আজ সে একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে। হল-ই বা তার বাবা, তার পাপ কি কোনও পাপ নয়? বিন্দুর সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল দশরথের— এটা সে ছেলে হয়ে মেনে নিয়েছিল মনে মনে। যে গরু দুধ দেয় তার লাথি খেতে হয়, যে মানুষ সংসারের হাল ধরে তার অনেক অন্যায় আব্দার মেনে নিতে হয়। বাবুয়া দিনে দিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল। কিন্তু মায়ার মৃত্যু তার মনে একটা বিরাট খাদের সৃষ্টি করে। ঠিক মত খাওয়া-দাওয়া আর চিকিৎসা পেলে তার মা হয়ত অসময়ে মরত না।

    দশরথ হাসপাতাল থেকে ফিরত পেট বোঝাই মদ নিয়ে। ঘরে এসে তার কথা বলার শক্তি থাকত না। কোনও মতে প্লাস্টিকের মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়ত সে। নেশার ঘোরে বিছানা নষ্ট করে দিত প্রায় দিন। হুঁশ ফিরলে আক্ষেপের স্বরে বলত, নেশাটা রক্তে সিঁধিয়ে গিয়েছে বাপ। ওটা আর ছাড়তে পারব না এ জীবনে। আমি মরলে আমার চিতায় মদ ঢেলে দিস তুই। তা হলে আমার আত্মা সঙ্গে যাবে—

    সদর হাসপাতালের লাশ কাঁটা ছেঁড়ার কাজ করত দশরথ। ডেডবডির হাতের আংটি পর্যন্ত সে খুলে নিত চতুর দক্ষতায়। এত নিয়েও তার পেট ভরত না। দিনরাত টাকার পেছনে দৌড়াত। বেতনের পুরো টাকাটা সে মাসের প্রথমে গুঁজে দিত বিন্দুর সোহাগ পাওয়ার জন্য। বিন্দু ছিল চতুর বেড়াল, পরপুরুষের গায়ে গাছের ছালের মত লেপটে যেত। মিঠে কথায় সে মন জয় করে নেয় দশরথের। দশরথও চিটেগুড়ে আটকে যাওয়া মাছি, আর বেরোতে পারে না। ঘরে অসুস্থ বউ খাবার না পেয়ে শুকোয়। বাবুয়া ডাকতে যেত তার বাবাকে। বিন্দু মুখের ওপর দড়াম করে দরজা ভেজিয়ে দিত। মুখ কাল করে ঘরে ফিরে আসত বাবুয়া। রাগে বই-খাতাপত্তর সব ছুড়ে ফেলে দিত ঘরের মেঝেয়। লালি এসে আবার গোছাত। বাবুয়া লালির মুখের দিকে তাকাত পারত না লজ্জায়। এই লজ্জাই একদিন প্রেম হয়ে ধরা পড়ল লালির ঠোঁটে। সে দিন বাবুয়া লালিকে চোখ রাঙিয়ে বলেছিল, খবরদার, তুই আমার ঘরে আসবি না। তোর চোখ দুটো ভাল নয়।

    লালি সে দিন চোখ ভরিয়ে কেঁদেছিল। বাবুয়া তার জলে ধোওয়া মুখের দিকে ফিরেও তাকায়নি। সে তখন মায়ের সেবা-যত্ন নিয়ে ব্যস্ত। মায়া সব শুনেছে পরের মুখে। স্বামীর নিন্দা-কলঙ্ক তার বুকের ক্ষত আরও বাড়িয়ে তোলে। একদিন সে বাবুয়াকে কাছে ডেকে পাখির ক্ষীণ গলায় বলে, বাপ, আমার সময় হয়েছে। আমি চলে যাব। যাওয়ার আগে তোকে একটা কথা বলি— আমার কথাটা রাখিস যেন। আমি মরে গেলে তোর হাতের যেন আগুন পাই।

    ঝড়জলের রাতে চোখ মুদল মায়া। সে আগুন পায়নি। দশরথ তাকে পুঁতে দিল গোরস্থানে। বাবুয়ার প্রতিবাদে সে বলেছিল, মড়া পোড়ানোর কাঠ নেই। ভেজা কাঠ কিনে পোড়াব যে তোর মাকে তেমন পয়সাও হাতে নেই। মাসের শেষ এখন। এই সময় সবার হাত খালি। কার কাছে হাত পাতব?

    বাবুয়া ছুটে গিয়েছিল লালির কাছে। লালি তার গলার ভরি খানেকের রুপোর হারটা খুলে দিয়ে বলেছিল, এ ছাড়া আমার আর কিছু নেই। ওটা নিয়ে যাও। যদি কোনও কাজে লাগে।

    বাবুয়া নিতে পারেনি, সে ফিরে এসেছে শূন্য হাতে। বিন্দুর কাছে যাওয়ার কথা কেউ তাকে বলেছিল। সে যায়নি। ঘৃণায় থুথু ফেলে বলেছে, ওর জন্য আমার মা মরল! ওর কাছে যাওয়া মানে মাকে আরও ছোট করে দেওয়া। ভেজা মাটিতে কবর দেওয়া হল মাকে। আবার ভরপেট মদ খেল দশরথ। শোক ভুলতে সে চলে গেল বিন্দুর ঘরে।

    শোকের কাজল পরে সেই থেকে বাবুয়া পাগলের মত ঘুরছে। দশরথের ছায়া সে আর মাড়াতে চায় না। যদিও দশরথ এখন তার প্রতি সদয় তবু বাবুয়া তার মুখের দিকে তাকায় না। মাতৃঘাতককে কোনও দিন সে ক্ষমা করবে না। লালি তাকে বোঝায়, সে তোমার বাপ হয়, তাকে ভুল বুঝো না।

    — বাপ না জহ্লাদ?  বাবুয়া বিকৃত স্বরে হেসে ওঠে। সে সময় পেলেই চলে যায় তার মায়ের কবরের কাছে। একা একা ফুঁপিয়ে ওঠে, মা, তোর মুখে আমি আগুন দিতে পারলাম না— তুই আমাকে ক্ষমা করে দে মা। তুই চলে যাবার পর এই এত বড় পৃথিবীতে আমি একা।

    তার কান্না বাতাস বয়ে নিয়ে যায় স্বর্গে। মায়ার কবরের কাছে দাঁড়ালে বাবুয়ার বুক হালকা হয়ে আসে, ব্যথা-ভার লাঘব হয়। ধীরে ধীরে সে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

     

    মাস তিনেক পরের ঘটনা।

    বাবুয়া কবরের সামনে এসে দেখল মাটি খোঁড়া। কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে মায়ের কঙ্কাল। বাবুয়া পাগলের মত ছুটে এসেছে লালির কাছে। লালি প্রথমে তার কাছে মুখ খুলতে চায়নি। অনেক পরে সে বলল, তোমার বাবাই এর পিছনে আছে। আজ জুগনু মহাজন এসেছিল। তোমার বাবাকে অনেক টাকা দিয়ে গেল। আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওরা মুখোমুখি বসে অনেকক্ষণ ধরে মদ খেল। বিন্দুমাসিও এসেছিল তোমাদের ঘরে। শুয়োরের মাংস দিয়ে সেও মদ খেল।

    লাশকাটা ঘর থেকে হাপিস হয়ে যায় বেওয়ারিশ লাশ। নিয়ম মত ওগুলো পুঁতে দেওয়ার কথা। যারা পুঁতে দেয় তারা টাকা পায়। দশরথ সৎকার পার্টির মাথা। তার কিছু চেনা-জানা বেকার ছেলে আছে। তারাই দশরথের ডান হাত, বাঁ হাত। মায়াকে কবর দেওয়ার সময় সেই ছেলেগুলো এসেছিল। মাত্র হাত দেড়েক মাটি কেটেই তারা মায়ার বুকে মাটি চাপিয়ে দেয়। সে দিন কেন এমন করেছিল আজ স্পষ্ট বুঝতে পারে বাবুয়া।

    চা-দোকান থেকে বেরিয়ে এসে সে এক দৃষ্টিতে পাকা রাস্তার দিকে তাকাল। হাইওয়ে গঙ্গার গা-ঘেঁষে চলে গিয়েছে কলকাতার দিকে। জুগনু মহাজনের আড়তটা গঙ্গার ওপারে। ভ্যান-রিকশা ঘাটের কাছে এসে থামলেই নৌকোয় লোড হয়ে যাবে বস্তা বোঝাই মাল। হাড় কঙ্কাল খুলি চালান যাবে কলকাতায়। ওখানে চড়া দাম এগুলোর। মাত্র ক’বছরেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে জুগনু মহাজন। গঙ্গার ওপারে তার ম্যাটাডর দাঁড়িয়ে থাকবে। লোকজন ফটাফট তুলে দেবে মাল। পুলিশ আর পাবলিকের কারওর কিছু বলার নেই। যে বেশি ফটর ফটর করবে তার হাতে নোট গুঁজে দেবে মহাজন।

    পুরো ঘটনাটা লালির মুখ থেকে শুনে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছে বাবুয়ার কান। প্রথমে তার বিশ্বাস হয়নি। টাকার জন্য মানুষ এত নীচে নামতে পারে?  হাড় কঙ্কাল খুলি দিয়ে কী হবে বাবুদের?

    লালি বলেছিল, এগুলো যারা ডাক্তারি পড়ে তাদের কাজে লাগে। কাজে না লাগলে মানুষ এত চড়া দাম দিয়ে কিনবে কেন?

    — আমার মায়ের দেহটা কে উঠিয়ে নিয়েছে?  তুই কি জানিস?

    — জানি, তবে বলতে ভয় করে। লালি তার শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়ায়, বাবুয়ার ধমক খেয়ে সে প্রায় কাঁদ কাঁদ স্বরে বলেই ফেলে, এটা তোমার বাবার কাজ। সাড়ে বারশো টাকায় সে তোমার মায়ের হাড়গোড় মাথার খুলি বেচে দিয়েছে জুগনু মহাজনকে।

    বাবুয়া চিৎকার করে উঠেছে লালির মুখে হাত চাপা দিয়ে, চুপ কর, আর বলিস নে। আমি পাগল হয়ে যাব। এমন কথা না শুনলেই বুঝি ভাল হত। লালি রে, আমি আর কোনও দিন বাপের মুখের দিকে তাকাতে পারব না। সে যদি আমার বাপ না হত তা হলে তার মুণ্ডু আমি দেহ থেকে আলাদা করে দিতাম। তাতে আমার পাপ হত না, আমার মায়ের আত্মা শান্তি পেত।

    — মাথা গরম কোরো না, এখনও সময় আছে গঙ্গার ধারে চলে যাও। লালি তার ঘেমো হাতটা বাবুয়ার মাথার ওপর রাখে, আমি যত দূর জানি — মালগুলো এখনও গাঙ্ পেরিয়ে ও পারে যায়নি। একবার গাঙ্ পেরিয়ে গেলে সব তোমার ধরা ছোঁওয়ার বাইরে চলে যাবে। যাও, আর সময় নষ্ট কোরো না। ছেলে হয়ে মাকে বাঁচাও।

    সেই যে ছুটেছে বাবুয়া, দম নিয়েছে চা দোকানের সামনে এসে। রোদ সরে গেছে ধীরে ধীরে। প্রতীক্ষার পালা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। কোথায় ভ্যান-রিকশা— কোনও কিছুই তার নজরে পড়ল না। কাছিমের মত ঘাড় তুলে দেখতে দেখতে ব্যথা হয়ে গেছে তার শরীর। ভেঙে গেছে মন। তা হলে কি লালি তাকে মিথ্যা কথা বলল?  কী স্বার্থ জড়িয়ে আছে যার জন্য মিথ্যা কথা বলল লালি?  এ পৃথিবীতে একটা মানুষও কি নেই যাকে বিশ্বাস করে বিধ্বস্ত মনটাকে লতিয়ে দেওয়া যাবে?  চেয়ে চেয়ে চোখের মণি কড়কড়িয়ে ওঠে বাবুয়ার। এভাবে সে তো হেরে যেতে পারে না। মাকে সে কথা দিয়েছিল তার সদ্গতি করবে। সন্তান হয়েও কথা রাখতে পারেনি সে। তাকে হারিয়ে দিয়েছে কুচক্রী মানুষ। তাকে সে ক্ষমা করতে পারবে না কোনও দিনও।

    আলো কমে আসার আগেই সে ফিরে যাবে বাসায়। ঠাস করে চড় মারবে লালির ফর্সা গালে। পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেবে সে। ওই কচি মুখের কথা শুনে আজ তার লাঞ্ছনা। এই মনোকষ্টের দাম লালি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কোনও দিনও নয়। ওই অতটুকু মেয়ের তাকে দেওয়ারই বা কী আছে!

    ভাঙাচোরা মন নিয়ে ফিরে আসার সময় বাবুয়ার নজর পড়ল টুকুস টুকুস চালে এগিয়ে আসা ভ্যান-রিকশাটার ওপর। হলুদ পলিথিনে ঢাকা ভ্যান-রিকশার মাল। বাবুয়া শরীর টানটান করে দাঁড়াল। সে যেন দূর থেকে তার মায়ের অতি চেনা সুগন্ধে ব্যাকুল হয়ে উঠল। তার তর সইল না আর। দুপদাপ পায়ে সে ছুটে গেল ভ্যানের দিকে।

    ভ্যান-চালক শ্রীধর তার অতিচেনা। বাবুয়া গিয়ে হ্যাণ্ডেলে হাত রাখল। শ্রীধর ব্রেক কষে দাঁড়িয়েছে রাস্তার একপাশে। কিছুটা ঘাবড়ে যাওয়া গলায় সে বলল, আমাকে যেতে দে। নৌকো ছেড়ে গেলে আমাকে অনেকক্ষণ ঘাটে বসতে হবে।

    — ভ্যানে কী আছে?  বাবুয়া রুক্ষ গলায় শুধোল।

    শ্রীধর বলল, তোর বাবার জিনিস। জুগনু মহাজনের ডেরায় যাবে—

    —খোল, কী আছে দেখব। বাবুয়া চিল্লিয়ে উঠল।

    বিচলিত শ্রীধর এ বার রুখে দাঁড়াল, পথ ছাড়, আমাকে যেতে দে। এগুলো খোলামকুচি। এগুলোর কোনও দাম নেই।

    —চল। আমি তোর সঙ্গে যাব। বাবুয়া চেপে বসল ভ্যানে।

    গঙ্গার পাড়ে এসে ভ্যান দাঁড় করাল শ্রীধর। বাবুয়া টেনে খুলে দিল পলিথিন। পাঁচটা বস্তার মুখ খুলে সে বালিতে বিছিয়ে দিল হাড়গোড় খুলি। চিৎকার করে বলল, মা, তুমি কোথায়?  আমি তোমাকে চিনতে পারছি না! কান্নায় ডুকরে উঠল উদ্ভ্রান্ত বাবুয়া।

    এক সময় হাড়গোড় খুলি নিয়ে সে ছুটে গেল গঙ্গায়। ভরা গাঙে ভাসিয়ে দিল মরা মানুষের অস্থি, খুলি।

    শ্রীধর পাগলের মত বলল, এ কী করলি বাবুয়া, এত টাকা তুই জলে ফেলে দিলি?  জানিস কত টাকা লস হল তোর বাবার?

    লাভক্ষতির হিসাব মেলানো বড় কঠিন। বাবুয়া গঙ্গায় ডুব দিয়ে এসে বিড়বিড় করে বলল, মা, আমি পেরেছি।

    অনিল ঘড়াই
    অনিল ঘড়াই
    কথাশিল্পী অনিল ঘড়াই (১ নভেম্বর, ১৯৫৭—২৩ নভেম্বর, ২০১৪) ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের একজন বাঙ্গালী সাহিত্যিক। ২৫ বছর বয়সে প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থ কাক এবং ৩২ বছর বয়সে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস নুনবাড়ি দিয়েই তার স্বতন্ত্র যাত্রা শুরু হয়। ঔপন্যাসিক ও গল্পকার পরিচয়ের আড়ালে তিনি ছিলেন অসাধারণ এক আত্মভোলা কবি। গল্প, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে গ্রন্থের সংখ্যা ৭০-৮০-র মত।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here
    Captcha verification failed!
    CAPTCHA user score failed. Please contact us!

    ভাঙার গান

      ১   কারার ওই লৌহ-কবাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট   রক্তজমাট   শিকল-পুজোর পাষাণবেদি! ওরে ও তরুণ ঈশান! বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ!   ধ্বংসনিশান   উড়ুক প্রাচী-র প্রাচীর ভেদি।   ২   গাজনের বাজনা বাজা কে মালিক? কে সে রাজা?   কে দেয় সাজা   মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে? হা হা হা পায় যে...

    নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে

    নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে, হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে হৃদয়ে রয়েছ গোপনে। বাসনা বসে মন অবিরত, ধায় দশ দিশে পাগলের মতো। স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত জাগিছ...

    স্বাধীনতা তুমি

    স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা- স্বাধীনতা তুমি শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা স্বাধীনতা তুমি পতাকা-শোভিত...

    কেউ কথা রাখেনি

    কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিলো শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে তারপর কত চন্দ্রভুক...

    পাদটীকা

    গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়। পাঠান-মোগল আমলে যে দুর্দৈব ঘটেনি ইংরাজ...

    সাতঘরিয়া

    মনপত্থল গাঁয়ের সামনের দিকে সরকারী পাকা সড়ক; এখানে যাকে বলে পাক্কী। পেছনে দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাত। কোয়েল এখন নামেই নদী। এই জেঠ মাহিনা অর্থাৎ...

    রস

    কার্তিকের মাঝামাঝি চৌধুরীদের খেজুর বাগান ঝুরতে শুরু করল মোতালেফ। তারপর দিন পনের যেতে না যেতেই নিকা করে নিয়ে এল পাশের বাড়ির রাজেক মৃধার বিধবা...

    লেখক অমনিবাস

    এই বিভাগে