সপ্তাহের সেরা

    আখ্যাত রচনা

    ইতিহাসকড়ি কাহিনি

    কড়ি কাহিনি

    একটি পুরোনো লেখাকে অনেক নতুন তথ্য ও ভাবনা যোগ করে আবার লেখা —  কড়ি কাহিনি।

    | কড়ি ও বিশ্ব-বাণিজ্য |

    সাধারণভাবে বেশ কিছু প্রজাতির মৃত সামুদ্রিক শামুকের খোলকে কড়ি বলে অভিহিত করা হলেও এর মধ্যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে মূলত ভারত মহাসাগরের একটি প্রজাতির (বৈজ্ঞানিক নাম: ‘মনেটারিয়া মনেটা’) খোলই ব্যবহৃত হয়েছে। দুস্প্রাপ্যতা, কম ওজন এবং আকার ও গুণমানের পরিবর্তন করা সম্ভব নয় বলে কড়ি প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মধ্যযুগে এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কড়ি বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হতো। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয়রা পশ্চিম আফ্রিকা থেকে অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের অপর প্রান্তে দাস সরবরাহের যে ব্যবসা করত, সেই ব্যবসার একটা বড় অংশের লেনদেন হতো মালদ্বীপ থেকে সমুদ্রপথে পশ্চিম আফ্রিকায় আমদানি করা কড়ির মাধ্যমে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দাস ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পরও পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ইউরোপে পাম তেল আমদানির জন্য কড়ি ব্যবহৃত হয়েছে।[১] উনিশ শতকের শেষে কিছুকাল মালদ্বীপের পরিবর্তে জাঞ্জিবার থেকে পশ্চিম আফ্রিকায় বৃহদাকার কড়ি রপ্তানি করা হয়েছিল।[২] পশ্চিম আফ্রিকার কিছু এলাকায় বিংশ শতকের গোড়ার দিকেও কড়ি বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে প্রচলিত ছিল।

    বাংলায় দুই সহস্রাব্দেরও বেশি কালপর্ব জুড়ে কড়ি বাণিজ্যিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলা বা তার পার্শ্ববর্তী কোনও অঞ্চলে কড়ি পাওয়া যায় না, মালদ্বীপ থেকে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথে কড়ি বাংলায় আমদানি করা হতো। মালদ্বীপে কড়ি শুধু রপ্তানির জন্য নয়, অভ্যন্তরীণ বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবেও বহু প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহৃত হয়েছে। চতুর্দশ শতকের চল্লিশের দশকে মরক্কোর পর্যটক ইবন বতুতা তাঁর মালদ্বীপে অবস্থানের সময় দেখেছেন, মালদ্বীপের অধিবাসীরা সমুদ্র থেকে সংগৃহীত কড়ি বাংলায় রপ্তানি করে বাংলা থেকে চাল আমদানি করত। ইবন বতুতা তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে কড়ির সঙ্গে মালদ্বীপের অন্য প্রচলিত মুদ্রার তত্কালীন বিনিময় মূল্যেরও উল্লেখ করেছেন[৩] পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে চিনের মিং বংশীয় শাসকের নৌসেনাপতি ঝেং হি সাতবার ভারত মহাসাগরের তটবর্তী দেশগুলিতে পরিভ্রমণ করেন। তাঁর তিনবারের যাত্রাসঙ্গী দোভাষী মা হুয়ান রচিত ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘ইংইয়া শেংলান’ ১৪৫১ সাধারণাব্দে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মা হুয়ান জানিয়েছেন, সেই সময় মালদ্বীপের অধিবাসীরা ভারত মহাসাগর থেকে জাল দিয়ে কড়ি শামুক ধরত, তারপর তাদের দেহগুলি পচে ঝরে গেলে খোলগুলিকে থাইল্যান্ড, বাংলা ও অন্যত্র রপ্তানি করত।[৪] ষোড়শ শতক সাধারণাব্দের প্রথম দিক থেকে পোর্তুগিজরা ক্রমশ ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। তারা মালদ্বীপের কড়ি রপ্তানির ব্যবসার উপরও নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। এই সময় থেকে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পোর্তুগিজরাই মুখ্যত মালদ্বীপ থেকে বাংলায় কড়ি আমদানি করত। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি ওলন্দাজরা ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জনের পর তারা মালদ্বীপ থেকে বাংলায় কড়ি আমদানি করতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে প্রথমে ফরাসি ও তারপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওলন্দাজদের মালদ্বীপ থেকে কড়ি রপ্তানির উপর একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটায়।[৫]

    | প্রাচীন ও আদি-মধ্যযুগের বাংলা |

    প্রাচীন বাংলায় বিনিময় মাধ্যম হিসাবে কড়ির প্রচলন কবে শুরু হয়েছিল তা বলা কঠিন, তবে আধুনিক বিদ্বানদের অনুমান মৌর্য যুগ থেকে বাংলায় কড়ি বিনিময় মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।[৬] চিনা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ফা সিয়ান পঞ্চম শতক সাধারণাব্দের প্রথম দিকে ভারতে এসেছিলেন। তিনি মধ্যদেশে (অর্থাৎ বর্তমান উত্তর ভারতে) বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য কড়ির ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন।[৭] সম্ভবত আদি-মধ্যযুগে কাশ্মীর থেকে অসম পর্যন্ত সমস্ত উত্তর ও পূর্ব ভারতে কড়ি বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হত।[৮] কড়ি নিয়ে বাংলার প্রবাদ ও প্রবচন, যেমন, ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’ এবং এককড়ি, দুকড়ি, তিনকড়ি, পাঁচকড়ি বা সাতকড়ি নামগুলি আজও বাংলায় দীর্ঘদিননের বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে কড়ির গুরুত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। বাংলায় গুপ্ত অধিকার ও তার পরবর্তী কালপর্বের সুবর্ণমুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেলেও, অষ্টম শতক থেকে পাল রাজবংশের আমলে বাংলায় সোনার মুদ্রা প্রায় দেখাই যায়নি, রূপো ও তামার মুদ্রার সম্ভবত তখনও প্রচলন ছিল। পালবংশীয় শাসকদের আমলে কড়ি ছিল বাংলার বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম। নবম শতকের মাঝামাঝি আরব বণিক সুলেইমান তাঁর ‘সিলসিলাত আল-তাওয়ারিখ’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, সেই সময় কড়িই ছিল বাংলায় বাণিজ্যের মাধ্যম, বাংলার প্রচলিত মুদ্রা।[৯] এরপর সেন ও বর্মন রাজবংশের আমলে বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলে একমাত্র কড়ি ছাড়া আর কোনও বিনিময় মাধ্যমের অস্তিত্ব ছিল বলে মনে হয় না। অবশ্য, এই একই সময়ে বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলবর্তী অঞ্চলে চন্দ্র বংশীয় রাজাদের শাসনাধীন হরিকেল রাজ্যে রূপোর মুদ্রার বহুল প্রচলন ছিল।

    সেন আমলের একাধিক তাম্রশাসনে পুরাণ ও কপর্দক পুরাণ নামের দুটি মুদ্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু, এই দুই নামের কোনও মুদ্রার সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। বাংলা ভাষায় কড়ি শব্দটি সংস্কৃত কপর্দক শব্দ থেকে উদ্ভূত আর পুরাণ বিভিন্ন গ্রন্থে রৌপ্যমুদ্রা বলে উল্লিখিত। খুব সম্ভবত, সেনবংশীয়দের রাজত্বকালে পুরাণ ও কপর্দক পুরাণ নামের দুই কাল্পনিক রৌপ্যমুদ্রার মূল্যমান কেবল বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গণনার সময় ব্যবহৃত হত, বাস্তবে সমস্ত বিনিময় হত কড়ির মাধ্যমে।[১০] মিনহাজ-ই-সিরাজ জুজ্জানি তাঁর ‘তবকাত-ই-নাসিরি’ (১২৫৯ সাধারণাব্দ) গ্রন্থে লিখেছেন, লক্ষ্মণসেনের আমলে বাংলায় জিতল অর্থাৎ রূপোর মুদ্রার বদলে কড়ি ব্যবহৃত হত এবং লক্ষ্মণসেন ১ লক্ষ কড়ির কমে কোনও দান করতেন না।[১১]

    গণিতবিদ ভাস্করাচার্য, তাঁর ১১৫০ সাধারণাব্দে লেখা ‘লীলাবতী’ (১.২) গ্রন্থে তৎকালীন বিভিন্ন মুদ্রার মধ্যে বিনিময় হার সম্বন্ধে জানিয়েছেন, “বরাটকানাং দশকদ্বয়ং যৎ সা কাকিণী তাশ্চ পণশ্চতস্রঃ।/ তে ষোড়শ দ্রম্ম ইহাবগম্যো দ্রম্মৈস্তথা ষোড়শভিশ্চ নিষ্কঃ॥”[১২] অর্থাৎ, ২০ বরাটক (কড়ি) = ১ কাকিণী; ৪ কাকিণী = ১ পণ; ১৬ পণ = ১ দ্রম্ম; ১৬ দ্রম্ম = ১ নিষ্ক। কাকিণী তামার মুদ্রা, পণ ও দ্রম্ম রৌপ্যমুদ্রা এবং নিষ্ক স্বর্ণমুদ্রা। অনুমান করা যায়, ‘লীলাবতী’ গ্রন্থে ১ রৌপ্যমুদ্রার (দ্রম্ম) মূল্য ১২৮০ কড়ি বলে যে উল্লেখ করা হয়েছে, তা সম্ভবত ঐ সময়কার বা তার আগেকার মূল্য।

    কেন সেন আমলে সোনা, রূপা ও তামার মুদ্রা বাংলা থেকে একেবারে বিলুপ্ত হল আর কড়ি একমাত্র বিনিময় মাধ্যমে পরিণত হল? আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে কারুর অনুমান, এই সময় বাংলার সমুদ্রপথে বৈদেশিক বাণিজ্য হ্রাসের ফলে সোনা ও রূপার মুদ্রার অভাব দেখা দিয়েছিল। এই অনুমান সম্ভবত সঠিক নয়। কারণ কড়ি ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যের সূত্রেই বাংলায় আসত। কোনও কোনও আধুনিক বিদ্বান আবার অনুমান করেন কড়ির ব্যাপক প্রচলনের মূল কারণ, এই সময় বাংলার বাণিজ্যের সিংহভাগ ছিল বর্তমান চিনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে, আর এই বাণিজ্যের মাধ্যম ছিল কড়ি, যা কিনা এই দুই স্থানেই মুদ্রা হিসাবে ব্যবহৃত হত।

    | অন্ত-মধ্যযুগের বাংলা |

    বখতিয়ার খলজির আক্রমণে বাংলায় সেন বংশের রাজত্বের অবসানের পর থেকে মোগল অধিকার পর্যন্ত প্রায় চার শতক যাবৎ (১২০৫-১৫৭৬ সাধারণাব্দ) সুলতান বলে উল্লিখিত বহিরাগত ও স্থানীয় ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকরা বাংলা শাসন করেন। এই সময় প্রথমে (১২০৫-১৩৩৮ সাধারণাব্দ) স্বল্প সংখ্যায়, তারপর (১২৩৮-১৪৯৪ সাধারণাব্দ) ব্যাপকতর সংখ্যায় এবং শেষে (১৪৯৪-১৫৭৬ সাধারণাব্দ) প্রভূত সংখ্যায় ৯৬-৯৮ শতাংশ শুদ্ধ রূপার মুদ্রা টঙ্কার (এই ‘টঙ্কা’ থেকেই আধুনিক বাংলা ভাষায় ‘টাকা’ এসেছে) প্রচলিত ছিল। কিন্তু, সমগ্র কালপর্ব জুড়ে বাংলার সাধারণ প্রজাদের বিনিময় মাধ্যম হিসাবে কড়ির ব্যবহার সমানভাবে চলতে থাকে। বাংলায় রূপোর কোনও অভ্যন্তরীণ উত্স নেই। সুলতানি আমলে প্রধানত বর্তমান উত্তর-পূর্ব মায়ানমার ও তার সংলগ্ন চিনের ইউনান প্রদেশের খনিগুলি থেকে উত্তোলিত রূপো বাংলায় আমদানি করা হত। ১৫১৬ সাধারণাব্দে পোর্তুগিজ ফ্যাক্টর (বাণিজ্যিক কর্মকর্তা) আন্টোনিও ডিনিস লিখেছেন, পেগু রাজ্যের রূপোর খনি থেকে বিপুল পরিমাণ রূপো পাওয়া যেত, এবং এর অধিকাংশই বাংলায় পাঠানো হতো। এই কালপর্বের বাংলায় সোনা ও তামার মুদ্রার ব্যবহার প্রায় ছিল না বললেই চলে। যে তামার মুদ্রাগুলি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি রূপোর পরত লাগিয়ে নকল মুদ্রা বানানোর জন্য নির্মিত বলে অনুমান করা হয়।[১৩] মা হুয়ান ১৪৩২ সাধারণাব্দে বাংলার স্বাধীন সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহের (রাজত্বকাল ১৪১৫-১৪১৬, ১৪১৮-১৪৩৩ সাধারণাব্দ) আমলে বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত অনুযায়ী, তৎকালীন বাংলায় বৃহৎ বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য রূপোর টঙ্কার ব্যবহার হতো আর ক্ষুদ্রতর ক্রয়বিক্রয়ের জন্য ব্যবহার হতো কড়ি।[১৪]

    ১৫৩৮ সাধারণাব্দে শের শাহ সুরি বাংলা জয় করেন। ১৫৪২ সাধারণাব্দে শের শাহ সুরি নতুন বিশুদ্ধ ও আগের চেয়ে ভারী রূপার মুদ্রা ‘রূপয়া’র প্রচলন করেন। ১৫৭৬ সাধারণাব্দে মোগল বাদশাহ আকবরের সেনা আফগান শাসক দাউদ শাহ করনানিকে পরাস্ত করে বাংলা জয় করে। মোগল আমলে সোনা, রূপো ও তামার মুদ্রার প্রচলন বাড়লেও কড়ির প্রচলন বন্ধ হয়নি। ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত স্থানীয় বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে কড়ির ব্যবহার হয়েছে। সুলতানি আমল, আফগান শাসন, মোগল আমল, নবাবী আমল, এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালের সূচনাকাল পর্যন্ত বাংলায় ভূমিরাজস্ব মুদ্রার বদলে কড়িতে দেওয়া যেত। মোগল আমলে, বাংলায় যাঁরা বাট্টা বা দস্তুরি নিয়ে কড়ির সঙ্গে সোনা বা রূপোর মুদ্রার বিনিময় করতেন তাঁদের বলা হত ‘পোতদার’ বা ‘পোদ্দার’। মোগল ও নবাবী আমলের বাংলায় রূপোর মুদ্রা ও কড়ির মূল্যমানের উপর নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের পরিবর্তে মুদ্রার বিনিময়কারীদের হাতে চলে এসেছিল। ১৭৬৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাট্টা নেওয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও তখন এই প্রথা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ১৭৯৪ সালের ১ মে কোম্পানির সিক্কা রুপির প্রচলনের মাধ্যমে এই প্রথা সমাপ্ত হয়।[১৫]

    বাংলায় সুলতানি আমল, মোগল আমল, নবাবী আমল ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে কড়ির সঙ্গে রূপোর মুদ্রার সম্পর্ক ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়েছে। ষোড়শ শতক সাধারণাব্দের প্রথম দিকে পোর্তুগিজ ঔষধ নির্মাতা তোমে পিরে বাংলা ও ওড়িশায় কড়িই প্রধান বিনিময়ের মাধ্যম ছিল বলে তাঁর বিবরণে উল্লেখ করেছেন। তিনি তত্কালীন বাংলায় প্রচলিত মুদ্রাগুলির মধ্যে যে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন, তা হল, ৮০ কড়ি = ১ পণ; ১৬ পণ = ১ কাহন; ৭ কাহন = ১ টঙ্কা (রৌপ্যমুদ্রা), অর্থাৎ, ১ টঙ্কা = ৮৯৬০ কড়ি।[১৬] ষোড়শ শতক সাধারণাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে রঘুনন্দন ভট্টাচার্য তাঁর ‘প্রায়শ্চিত্ততত্ত্ব’ গ্রন্থে বিভিন্ন প্রচলিত মুদ্রার মধ্যে প্রায় একই রকম সম্পর্কসূচক একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন, “অশীতিভির্বরাটকৈঃ পণ ইত্যভিধীয়তে।/ তৈঃ ষোড়শৈ পুরাণং স্যাৎ রজতং সপ্তভিস্তু তৈঃ॥”[১৭] অর্থাৎ, ৮০ বরাটক (কড়ি) = ১ পণ; ১৬ পণ = ১ পুরাণ; ৭ পুরাণ = ১ রজত। এক কথায় ১ রজত = ৮৯৬০ কড়ি। বাস্তবেও এই সময় বাংলায় প্রচলিত রৌপ্যমুদ্রা টঙ্কার মূল্য এর প্রায় কাছাকাছি ছিল। ষোড়শ শতকের শুরুতে ১ টঙ্কার মূল্য ছিল ৯০০০ কড়ি। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি ১ টঙ্কার মূল্য বেড়ে হয় ৯৬০০ কড়ি। ষোড়শ শতকের শেষে আবু’ল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে ওড়িশার তৎকালীন প্রচলিত মুদ্রাগুলির মধ্যে যে বিনিময় মূল্যের উল্লেখ করেছেন, তা হল, ৪ কড়ি = ১ গণ্ডা; ৫ গন্ডা = ১ বুড়ি; ৪ বুড়ি = ১ পণ; ১৬ বা ২০ পণ = ১ কাহন এবং ১০ কাহন = ১ রূপয়া (মোগল রৌপ্যমুদ্রা)।[১৮] অর্থাৎ, এই সময় মোগলদের প্রচলিত ১ রূপয়ার মূল্য ছিল ১২৮০০ বা ১৬০০০ কড়ি।

    | ঔপনিবেশিক আমলে বাংলা |

    ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে পূর্ব ভারতে তাদের অধিকৃত এলাকায় তামার মুদ্রার প্রচলনের সূত্রপাত করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস তামার মুদ্রার প্রচলনের মাধ্যমে বাংলার ক্ষুদ্র বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কড়িকে প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করেছিলেন। বাংলার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ জন প্রিন্সেপকে তামার মুদ্রা সরবরাহের জন্য বরাত দেয়। একই সঙ্গে তারা দাস ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য কোম্পানির জাহাজের মাধ্যমে তত্কালীন মূল্যমানের চেয়ে বেশি দামে বছরে ৬০ টন কড়ি ইংল্যান্ডে রপ্তানিরও বরাত দেয়। জন প্রিন্সেপ ১৭৮১-১৭৮২ সাল নাগাদ চুঁচুড়ার ওলন্দাজ গভর্নরের কাছ থেকে প্রচুর তামা কিনে বাংলার সরকারকে তামার মুদ্রা বিক্রয় করতে শুরু করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকরাও ব্রিটেন থেকে তামা আমদানি করেন।[১৯] বাংলার ঔপনিবেশিক সরকারের তামার মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন ও ইংল্যান্ডে কড়ি রপ্তানির সিদ্ধান্তের ফলে বাংলার হাটেবাজারে লেনদেনের জন্য কড়ির সংখ্যা হ্রাস পায়, অষ্টাদশ শতকের শেষে কড়ির ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।[২০] ১৭৭৮ সালে যেখানে ১ রুপির বিনিময় মূল্য ছিল ৫১২০ কড়ি সেখানে, অষ্টাদশ শতকের শেষে ১ রুপির বিনিময় মূল্য ছিল ২৪০০-২৫৬০ কড়ি।[২১] ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিক থেকে কড়ির মূল্যমান আবার কমতে শুরু করে।

    ১৮৩৩ সাধারণাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা ও অন্য অধিকারভুক্ত এলাকায় নিজেদের মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করে। ১৮৩৩ সালের ৭ নম্বর রেগুলেশন অনুযায়ী নতুন মুদ্রিত রূপোর মুদ্রা কলকাতা রুপির অন্য প্রচলিত মুদ্রার নিরিখে যে মূল্য নির্ধারিত হয়েছিল তা হল, ৪ কড়ি = ১ গণ্ডা; ২০ গণ্ডা = ১ পণ; ৫ পণ = ১ আনা; ১৬ আনা = ১ সিক্কা রুপি (কলকাতা রুপি)।[২২] অতএব, এই সময়, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১ সিক্কা রুপির মূল্য নির্ধারিত হয় ৬৪০০ কড়ি। ১৮৪৫ সাধারণাব্দে ১ রুপির মূল্য বেড়ে হয় ৬৫০০ কড়ি।[২৩] ঊনবিংশ শতকের শেষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতির ফলে বাংলায় চালের দাম বৃদ্ধি পায়, একই সময় ইংল্যান্ডে কড়ির রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যায়। সংখ্যার প্রাচুর্যের ফলে কড়ির মূল্যমান কমে যায়, অলাভজনক হওয়ার কারণে মালদ্বীপ থেকে কড়ি আমদানিও বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপক অবমূল্যায়নের পর বাংলার দুই সহস্রাব্দের বেশি প্রাচীন বিনিময়ের মাধ্যম কড়ির ব্যবহার বিলুপ্ত হয়ে যায়। বাংলার সমস্ত বিনিময়ের মাধ্যম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

    পাদটীকা

    1. Bin Yang, “The Rise and Fall of Cowrie Shells: The Asian Story” in ‘Journal of World History, Vol. 22, No. 1’; Honolulu: University of Hawaii Press, 2011, p. 20.
    2. C.A. Gregory, “Cowries and Conquest: Towards a Subalternate Quality Theory of Money” in ‘Comparative Studies in Society and History, Vol. 38, No. 2’; Cambridge University Press, April, 1996, p. 199.
    3. Mahdi Husain translated, ‘The Reḥla of Ibn Battuta (India, Maldive Islands and Ceylon)’; Baroda: Oriental Institute, 2nd edition, 1976, p. 201.
    4. J.V.G. Mills translated, ‘Ma Huan Ying-Yai Sheng-Lan, The Overall Survey of the Ocean’s Shores (1433)’; Cambridge: Cambridge University Press for the Haklyut Society, 1970, p. 150.
    5. James Heimann, “Small Change and Ballast: Cowry Trade and Usage as An Example of Indian Ocean Economic History” in ‘South Asia: Journal of South Asian Studies, Volume 3, Issue 1’; South Asian Studies Association of Australia, 1980, pp. 48-69.
    6. ibid, p. 48.
    7. James Legge translated, ‘A Record of Buddhist Kigdoms: Being An Account by The Chinese Monk Fā-Hien of His Travels in India and Ceylon (A.D. 399-414) in Search of The Buddhist Books of Discipline’; Oxford: The Calendron Press, 1886, p. 43; আরও দেখুন, H.A. Giles re-translated, ‘The Travels of Fa-hsien (399-414 A.D.), or Record of the Buddhist Kingdoms’; Cambridge: Cambridge University Press, 1923, p. 21 এবং “The Journey of the Eminent Monk Faxian (Taisho Volume 51, Number 2085)” in ‘Lives of Great Monks and Nuns’; Berkeley, California: Numata Center for Buddhist Translation and Research, 2002, p. 175.
    8. John S. Deyell, ‘Living without Silver, The Monetary History of Early Medieval North India’; New Delhi: Oxford University Press, 1990, pp. 62, 237.
    9. H.M. Elliot translated, ‘The History of India, As Told by Its Own Historians, Vol. I’; London: Trübner & Co., 1867, p. 5.
    10. নীহাররঞ্জন রায়, ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব’; কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৩ [১৯৪৯], পৃ. ১৬২।
    11. H.M. Elliot translated, ‘The History of India, As Told by Its Own Historians, Vol. II’; London: Trübner & Co., 1869, p. 307-308.
    12. Muralidhara Thākura edited, ‘The Līlāvati: A Treatise on Mensuration by Śrī Bhāskarāchārya’; Harikrishna Nibandha Bhawana, 1938, p. 1.
    13. John S. Deyell, “Cowries and coins: The dual monetary system of the Bengal Sultanate” in ‘The Indian Economic and Social History Review, Volume 47, Issue 1’; New Delhi: Sage Publications, 2010, pp. 63-106.
    14. J.V.G. Mills translated, ‘Ma Huan Ying-Yai Sheng-Lan, The Overall Survey of the Ocean’s Shores (1433)’; Cambridge: Cambridge University Press for the Haklyut Society, 1970, p. 161; আরও দেখুন, Nalini Kanta Bhattasali, ‘Coins and Chronology of the Early Independent Sultans of Bengal’; Cambridge: W. Heffer & Sons, 1922, p. 170.
    15. Narendra Krishna Sinha, ‘The Economic History of Bengal, Vol. I’; Calcutta: Firma KLM Private Limited, 1965, p. 132-141.
    16. Armando Cortesão translated and edited, ‘The Suma Oriental of Tomé Pires: An Account of the East, from the Red Sea to Japan, written in Malacca and India in 1512-1515, and The Book of Francisco Rodrigues: Rutter of a Voyage in the Red Sea, Nautical Rules, Almanack and Maps, Written and Drawn in the East before 1515 Volume I’; London: The Hakluyt Society, 1944, pp. 93-95.
    17. জীবানন্দ বিদ্যাসাগর সম্পাদিত, ‘স্মৃতিতত্ত্বস্য প্রথমো ভাগঃ, মহামহোপাধ্যায় শ্রীরঘুনন্দনভট্টাচার্য্য বিরচিতঃ’; কলিকাতা: নারায়ণ যন্ত্র, দ্বিতীয় সংস্করণম্, ১৮৯৫, পৃ. ৫১৭।
    18. H.S. Jarrett translated, ‘Ain-i-Akbari of Abul Fazl-i-‘Allami, Vol. II’; Calcutta: The Asiatic Society, 1993 [1948], pp. 138-139.
    19. Narendra Krishna Sinha, ‘The Economic History of Bengal, Vol. I’, pp. 142-154.
    20. James Heimann, “Small Change and Ballast: Cowry Trade and Usage as An Example of Indian Ocean Economic History”, p. 60.
    21. ibid, p. 58.
    22. J. Prinsep, ‘Useful Tables, Forming an Appendix to the Journal of the Asiatic Society, Part 1, Coins, Weights and Measures’; Calcutta: The Baptist Mission Press, 1834, p. 1.
    23. Edward Thomas, “The Initial Coinage of Bengal” in “The Journal of the Royal Asiatic Society of Great Britain and Ireland, New Series, Vol. 2, No. 1’; London: Trübner & Co., 1866, p. 147n1.
    জয়ন্ত ভট্টাচার্য
    জয়ন্ত ভট্টাচার্য
    যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক এবং তিন দশক যাবৎ বিমান প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাসের আগ্রহী পাঠক। সম্প্রতি ইতিহাস বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেছেন।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here
    Captcha verification failed!
    CAPTCHA user score failed. Please contact us!

    প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতে বিবাহের শাস্ত্রীয় শুভ মুহূর্ত

    প্রাচীন যুগ সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী প্রথম সহস্রাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিবাহের জন্য দিনের কোন সময়কে শুভ বলে বিশ্বাস করত, তা আজ নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।...

    লেখক অমনিবাস

    স্কন্দপুরাণ – সার্ধ সহস্রাব্দের বিবর্তন : চতুর্থ পর্ব

    স্কন্দপুরাণের আরও রূপ স্কন্দপুরাণের অংশ বলে উল্লিখিত বেশ কয়েকটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখনীয় অম্বিকা খণ্ড ও রেবা খণ্ড নামের...

    স্কন্দপুরাণ – সার্ধ সহস্রাব্দের বিবর্তন : প্রথম পর্ব

    প্রাক্-কথন আদি-মধ্যযুগের শুরুতে (সম্ভবত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতক সাধারণ অব্দের মধ্যবর্তী কোনও সময়M. Winternitz (Subhadra Jha translated), ‘History of Indian Literature, Vol. 3’; Delhi: Motilal...

    স্কন্দপুরাণ – সার্ধ সহস্রাব্দের বিবর্তন : পঞ্চম পর্ব

    স্কন্দপুরাণের রচনাকাল চারটি প্রাচীন নেপালি পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে সমীক্ষাত্মক সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর এখন আধুনিক বিদ্বানরা এই রূপটিই যে স্কন্দপুরাণের আদিরূপের সবচেয়ে নিকটবর্তী রূপ এ বিষয়ে...

    স্কন্দপুরাণ – সার্ধ সহস্রাব্দের বিবর্তন : দ্বিতীয় পর্ব

    স্কন্দপুরাণের সাত খণ্ড স্কন্দপুরাণের ৭ খণ্ড বিশিষ্ট রূপটির সম্পর্কে নারদ পুরাণের পূর্বার্ধের ১০৪তম অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। নারদ পুরাণে (১০৪.১৪২-১৬৭) বর্তমান নাগর খণ্ডের বিস্তারিত...

    প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতে বিবাহের শাস্ত্রীয় শুভ মুহূর্ত

    প্রাচীন যুগ সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী প্রথম সহস্রাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিবাহের জন্য দিনের কোন সময়কে শুভ বলে বিশ্বাস করত, তা আজ নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।...

    স্কন্দপুরাণ – সার্ধ সহস্রাব্দের বিবর্তন : তৃতীয় পর্ব

    স্কন্দপুরাণের ছয় সংহিতা স্কন্দপুরাণের মুদ্রিত সংস্করণে যে ৭ খণ্ডের রূপের আমরা দেখা পেয়েছি, তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক আর একটি ৬টি সংহিতা সমন্বিত রূপের অস্তিত্ব সম্পর্কেও...

    এই বিভাগে