সপ্তাহের সেরা

    আখ্যাত রচনা

    শেয়ালের কান্না

    প্রচণ্ড খরা চলছে দেশে। বনেও পড়েছে তার প্রভাব, বনের ছড়ায় ডোবায় খাঁড়িতে কোথাও এক ফোঁটা জল নেই। তবুও বনের প্রাণিরা সবচে গভীর খাঁড়িটার ধারে ঘুরে যায় একবার, কোন যাদু-মন্ত্রে যদি মিলে যায় এক ফোঁটা তৃষ্ণার জল। এভাবে রোজ রোজ ঘুরতে এসেই পরিচিত হয়ে ওঠে শেয়াল, কাক, ব্যাঙ আর পিঁপড়ে। খরা নিয়ে আলোচনা করতে করতে একদিন তারা সিদ্ধান্ত নেয়- জলের খোঁজে বের হবে, চলে যাবে দূর-দূরান্তে, যা পাওয়া যাবে ভাগ করে খাবে আর পান করবে কাউকে না ঠকিয়ে।

    চলতে চলতে প্রথম দিনটা ফুরিয়ে রাত নামে, জলের সন্ধান না পেয়ে প্রতিদিনকার মতো পাতা চিবিয়ে রস পান করে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়ে।

    দ্বিতীয় দিন চলতে চলতে বেলা যখন প্রায় ফুরিয়ে আসছে তখন পিঁপড়ে শুনতে পায় এক ফাটলের তলদেশে জল প্রবাহের মৃদু শব্দ। মাটিতে কান লাগিয়ে সবাই নিশ্চিত হয় সত্যি সত্যি বয়ে চলেছে জলের মৃদু একটা ধারা! তাতেই তাদের তৃষ্ণা বেড়ে যায় দ্বিগুণ।

    মুশকিল হলো, ফাটলের গভীরতা কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের কারণে। হাতের কাছে জল পেয়েও পান করা যাচ্ছে না ভাবতেই তারা রুষ্ট হয় নিজেদের ভাগ্যের ওপর। শেষে অস্থির হয়ে ব্যাঙ বলে- ‘ভাগ্যে যাই থাক, নেমে দেখি ফাটলে।’

    শেয়াল কাক আর পিঁপড়ে একসাথে ‘না!’ ‘না!’ বলে নিষেধ করে।

    ব্যাঙ বলে- ‘আর না বলো না বন্ধুরা, তৃষ্ণায় ছটফট করে মরার চাইতে একবার নেমেই দেখি, জানোই তো ব্যাঙের জলতৃষ্ণা কতো প্রবল।’ বলেই ফাটলে লাফিয়ে পড়ে ব্যাঙ। বেশ কিছুক্ষণ পর অনেক গভীর থেকে উঠে আসে জলে পতনের মৃদু একটা শব্দ।

    জলের ছোঁয়া পেতেই ব্যাঙটা বুক ভরে পান করতে থাকে ফাটলের জল। আহা জল! কী অপূর্ব স্বাদ! জীবনের অর্ধেকটা সময় জলে কাটিয়েও আগে কখনও খেয়ালই করেনি জলের ঘ্রাণ এতো মধুর!

    অনেক্ষণ ধরে ব্যাঙের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ফাটলের উপর উড়ে উড়ে কাক ডাকতে শুরু করে

    বন্ধু ব্যাঙকে। তৃপ্তির গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নীচ থেকে সাড়া দেয় ব্যাঙ- ‘

    ভাই, জল তো পাওয়া গেছে কিন্তু এতো গভীর খাদ বেয়ে উঠি কী

    করে! তোমাদের জল দেই কী করে?’

    শেয়াল চিৎকার করে বলে- ‘ভেবো না ব্যাঙ,

    আমরা তোমাকে তুলে আনবই, কিছুক্ষণ চুপচাপ

    বসে থাক আর বল খাদের গভীরতা কত হতে পারে?’

    ফাটলের তলা থেকে ব্যাঙ চিৎকার করে বলে- ‘এখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার ভাই, আবছা আবছা

     

    আলো দেখতে পাচ্ছি তোমার হাতে প্রায় ত্রিশ হাত উপরে।’

    ব্যাঙের কথা শুনে শেয়াল কাককে নিয়ে চলে যায় পাশের ঝোপে, একটা লতা বাছাই করে কামড়ে গোড়া ছিঁড়ে দেয়, কাককে অনুরোধ করে পঁচিশ-ত্রিশ হাত উপরে উড়ে গিয়ে লতার আগা ছিঁড়ে দিতে। কাজ শেষে শেয়াল লতা টেনে এনে একটা প্রান্ত নামিয়ে দেয় ফাটলের তলায়, উপরের প্রান্ত  কামড়ে ধরে থাকে কাক। এবার পিঁপড়ে নেমে যায় লতা বেয়ে ফাটলের তলায় আর উঠে আসে ব্যাঙ। একটু পরে তৃষ্ণা নিবারণ করে উঠে আসে পিঁপড়েটাও।

    এবার কাকের বুদ্ধিতে শেয়াল লম্বা একটা নল-খাগড়া তুলে এনে পিঁপড়েকে অনুরোধ করে নলের নরম পর্বগুলি ছিদ্র করে দিতে। ছিদ্র করা শেষ হলে শেয়াল আর কাক নলটা নামিয়ে দেয় ফাটলে। কিন্তু কিছুতেই নলের নীচের প্রান্ত জলে পড়ে না, অবস্থা দেখে ব্যাঙ আবার লতা বেয়ে নেমে যায় ফাটলের তলায়, নলের প্রান্ত বসিয়ে দিয়ে আসে পানিতে। এবার শেয়াল নলের মুখে মুখ লাগিয়ে টেনে আনে জল, প্রাণ ভরে পান করে সবাই মিলে।

     

    অনেক দিন পর পনি পান করে পরম তৃপ্তি পেলেও উপবাস তৃষ্ণা ভ্রমণ আর কাজের ধকলে চরম ক্লান্তি নেমে আসে সবার দেহ-মনে। ফাটলের পশেই ঘুমিয়ে পড়ে ওরা। কাক সবার আগে জাগার নিয়ম হলেও পরদিন ভোরে সবার আগে ভাঙে শেয়ালের ঘুম, আড়মোড়া ভেঙে পরম খুশিতে- ‘হই হই হইয়া-উু-উু……’ বলে চিৎকার করে উঠে। সবার আরামের ঘুম টুটে যায় তাতে, তবে কেউ বিরক্তি প্রকাশ না করে শেয়ালের সাথে চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশে মেতে ওঠে, তারপর পরষ্পরের প্রশংসাতে মেতে ওঠে সবাই।

     

    ব্যাঙ বলে- ‘ভাই পিঁপড়ে, তুমি পানির শব্দ শুনতে না পেলে মনে হয় এতোক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেতাম!’

    পিঁপড়ে বলে- ‘তাতে আর কী; তুমি সাহস করে লাফ না দিলে তো জলের শব্দ শুনতে শুনতেই মরে যেতাম!’

    কাক বলে- ‘শেয়াল ভাই, তুমি লতা নামানোর বুদ্ধি না দিলে তো ব্যাঙ ভাইকেই হারাতাম।’

    শেয়াল বলে- ‘তুমি নল-খাগড়ার বুদ্ধিটা না দিলে তো জল পেয়েও পান করা হতো না।’

    প্রশংসার পালা শেষ হলে শেয়াল বললো- ‘আচ্ছা, বৃষ্টি না নামা পর্যন্ত আমরা কি বন্ধু হয়ে এখানেই থেকে যেতে পারি না?’

    কাক বললো- ‘কিন্তু..’

     

    শেয়াল বললো- ‘দেখ, আমি মুরগি পছন্দ করি বটে, কাকতো আর খাই না।’

    কাক বললো- ‘আমিও ইঁদুর খাই, ব্যাঙ তো আর খাই না।’

    ব্যাঙ বললো- ‘আমিও অনেক কীট-পতঙ্গ খাই তবে পিঁপড়ে খাই না।’

    পিঁপড়ে বললো- ‘তবে আর ভাবনা কী? মানুষের আবাসের মতো গর্তের মুখে দরজা দেয়ার প্রস্তাব করেছি বলে আমাকে দল থেকে বের করে দিয়েছে, তাই দলে ফিরে গিয়ে আমারও কোন কাজ নেই।’

    এর পর থেকেই ওরা বন্ধু হয়ে ওখানেই থেকে সুখে কাল কাটাতে থাকলো। তবে বৃষ্টি আসি আসি করেও না আসাতে শেষে নেমে এলো দুর্ভিক্ষ, ঠিক মতো খাবার জুটে না কারো, বনের পশু পাখিরা সব দূরে কোথাও পালিয়ে গেছে নয় তো ক্ষুধা-তৃষ্ণায় প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু চার বন্ধু কোথাও যেতে পারছে না জলের ফাটলটা ফেলে, জলের ধারা ক্রমশ সরু হয়ে আসলেও এখনো তেষ্টা মেটানো যাচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালায় তারা অখাদ্য-কুখাদ্যও খেতেও শুরু করলো শেষে, একদিন সবাই মিলে খেলো ঝরে পড়া পাকা মহুয়া ফল। খেয়ে মাতাল হয়ে নাচতে নাচতে কে কোন পথ ধরলো ঠিক নেই। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে ব্যাঙটা দেখলো পিঁপড়েটা মাতাল হয়ে নাচছে খুব, একবার মনে হয় পিঁপড়ে আর একবার মনে হয় টসটসে একটা মৌমাছি। বিভ্রান্ত হয়ে এক সময় সে গপ্ করে খেয়েই ফেলে পিঁপড়েটাকে। একটু পরে মাতাল কাকটাও এসে হাজির হয় সেখানে, তার চোখেও ব্যাঙটাকে মনে হয় আস্ত একটা ধারি ইঁদুর, তবে পা গুলি ব্যাঙের মতো। এমন বিদঘুটে ইঁদুরটাকে খাবে কি খাবে না ভাবতে ভাবতে খেয়েই ফেলে‌ শেষ পর্যন্ত।

    কাক যখন মজা করে ব্যাঙ খাওয়া প্রায় শেষ করে এনেছে এমন সময় শেয়াল এসে হাজির। কাককে দেখে তার মনে হলো সুন্দর একটা মুরগি দাঁড়িয়ে আছে তবে মাথাটা কাকের মতো। বিদঘুটে মুরগিটা দেখে শেয়ালের মেজাজ গেল চড়ে, ধমক দিয়ে বললো- ‘এ্যাই মুরগি; কী করছিস এখানে?’

    কাকের মনে হলো বড় একটা বিদেশি কুকুর দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, পাল্টা ধমক ছেড়ে সেও বললো- ‘দূর হ কুত্তা, আমি মুরগি হব কেন? আমি হচ্ছি পাখির রাজা কাক! আর আমি ব্যাঙ খাই না।’

    ‘না তুই মুরগি, একশোবার তুই মুরগি, নইলে আমার বন্ধু ব্যাঙের পা কেন তোর সামনে পড়ে আছে মনে হচ্ছে। তোকে আমি…..’ এতটুকু বলেই শেয়াল ঝাঁপিয়ে পড়লো কাকের ওপর। কটমট করে চিবিয়ে খেয়ে ফেললো তাকে। আনেকদিন পর মুরগি-জ্ঞানে কাকের মাংস খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো শেয়াল।

    যখন তার ঘুম ভাঙলো তখন মাঝরাত, আকাশে হাসছে পূর্ণিমার চাঁদ, কেটে গেছে মহুয়ার নেশার ঘোর। মনে সন্দেহ দেখা দেয়াতে এদিক ওদিক খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলো মুরগির জায়গায় পড়ে

     

    আছে কাকের মাথা আর পালক, একটু দূরেই একজোড়া ব্যাঙের ঠ্যাং- যাতে লেগে আছে পিঁপড়ের গন্ধ। শেয়ালের বুঝতে বাকি রইলো না মাতাল হয়ে কে কী করেছে। বন্ধু বিরহে অনুতপ্ত শেয়াল

    চাঁদের দিকে চেয়ে কাঁদতে শুরু করলো-‘উহ্ আ-হা-হা; উহ্ হা হা হা…..।’

    চাঁদকে কখনও ভালো করে খেয়াল করে দেখেনি শেয়াল, সেদিনই প্রথম দেখলো। তার মনে হলো চাঁদের বুকেই মন ভার করে বসে আছে কাক, ব্যাঙ আর পিঁপড়ে। আরও কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করার পর সে ভাবলো, এখানে থাকলে বন্ধুদের স্মৃতি সব সময় কষ্ট দেবে মনে, তাই চলে যাবে যেদিকে দু’চোখ যায়। যেখানেই যাবে আর কোন দিন ছুঁয়েও দেখবে না মাতাল হওযার মতো কোন কিছু, ক্ষুধায় মরে গেলেও এমন কোন খাবার খাবে না, যা খেলে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-পরিজনজ্ঞান লোপ পায়।

    এরপর শেয়াল চলতে চলতে চলে যায় অনেক অনেক দূরের এক বনে, খুঁজে নেয় নতুন নতুন বন্ধু। প্রাণপণে ভুলে থাকতে চেষ্টা করে পুরানো দিনের কষ্ট। তবুও পূর্ণিমা রাতে চাঁদের দিকে তাকালেই উথলে উঠে তার বন্ধু বিরহের শোক। তখনই সে কেঁদে ওঠে- ‘উহ্-হা-হা-হা-আঁ, উহ্-হা-হা-হা-আঁ……।’

    আর মানুষ শুনে-‘হাক্কা হুঁ য়া য়া…..,হাক্কা হু য়া য়া…..।’

    অনিন্দ্য বড়ুয়া
    অনিন্দ্য বড়ুয়া
    কবি, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক। জন্ম চট্টগ্রামে।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here
    Captcha verification failed!
    CAPTCHA user score failed. Please contact us!

    গার্ড অব অনার

    বিগত এক মাস ধরে পুরো বাংলাদেশ জুড়ে প্রচণ্ড উত্তেজনা। খুন-খারাপি ছিনতাই প্রতারণার খবর চাপিয়ে পত্রিকার পাতায় পাতায় শুধু বাংলাদেশের প্রথম চন্দ্রাভিযানের খুঁটিনাটি ফলোআপ। খেয়াযান...

    লেখক অমনিবাস

    খিদে

    আদিম অনার্য আমি, আধুনিক এ পোশাকের নিচে একই খিদে একই লোভ, একই অনুভবে আছে আজও সেই পুরাতন কাম কাতরতা। প্রাচীন সে প্রণোদনা থেকে হয়তোবা,...

    মনোরম সাঁঝ

    জলে যে জীবন আছে তারাও কি জ্বলে প্রেমে পড়ে তাদেরও কি আছে নাকি সামাজিক বাধা, এক হতে তারাও কি ঘর ছাড়ে, বাধা আসে নানা ধর্ম...

    গার্ড অব অনার

    বিগত এক মাস ধরে পুরো বাংলাদেশ জুড়ে প্রচণ্ড উত্তেজনা। খুন-খারাপি ছিনতাই প্রতারণার খবর চাপিয়ে পত্রিকার পাতায় পাতায় শুধু বাংলাদেশের প্রথম চন্দ্রাভিযানের খুঁটিনাটি ফলোআপ। খেয়াযান...

    এই বিভাগে