সপ্তাহের সেরা

    আখ্যাত রচনা

    বিভক্তি

    আমার ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছি, মান্তু মাটিতে বসে একটা পাখির ছবি আঁকতে ব্যস্ত, বুতান এসে বলল, ‘দাদু, বিভক্তি কাকে বলে?’

    মান্তু পাখি আঁকা থামিয়ে বলল, ‘ ওমা, দাদা, তুই এটাও জানিস না? বিভক্তি মানে বিভাজন মানে ভাগ করা।’

    শুনে বুতান গেল রেগে। চোখ গোলগোল করে বলল, ‘যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস না। আমি ব্যাকরণের বিভক্তি জানতে চেয়েছি।

    আমি প্রমাদ গুনলাম। এই বুঝি দুজনের লেগে গেল। তাড়াতাড়ি ওদের থামিয়ে বললাম, ‘মান্তু ঠিক বলেছে। বিভক্তি হল বি + ভজ্ (ধাতু) + তি। অর্থাৎ বিশেষ রূপে ভাগ করা। তবে বুতান জানতে চাইছে ব্যাকরণের বিভক্তি সম্বন্ধে।’

    – তাই নাকি দাদু? ব্যাকরণেও বিভক্তি আছে?’ মান্তু জিজ্ঞাসা করে।

    – আছে বৈকি। ব্যাকরণের বিভক্তি হল নামপদ বা ক্রিয়ার বাক্যে প্রবেশের ছাড়পত্র। বিভক্তি হল বিশেষ্য, বিশেষণ বা ক্রিয়ার পাসপোর্ট। নামপদের বেলায় তাকে বলে শব্দ বিভক্তি আর ক্রিয়ার ক্ষেত্রে তাকে বলে ক্রিয়া বিভক্তি। তবে সঠিক ভাবে বলতে গেলে একে পাসপোর্ট না বলে ভিসা বলাই বোধ হয় যুক্তিযুক্ত।

    মান্তু বলল, ‘ভিসা মানে? আমরা যখন অন্য কোন দেশে বেড়াতে যাই তখন তো ভিসা করাতে হয়।’

    – ঠিক তাই। ভিসা ছাড়া যেমন অন্য কোন দেশে ঢোকা যায় না তেমনি বিভক্তি ছাড়া কোন নামপদ বাক্যে ব্যবহার করা যায় না। যেমন ধর, যদি বলি, “বুতান আর মান্তুকে এখন স্কুলে যেতে হবে”। এই বাক্যে ‘মান্তুকে’ আর’ স্কুলে’ শব্দ দুটো লক্ষ কর। মান্তু + কে আর স্কুল + এ। এই কে আর এ এগুলো হল বিভক্তি।

    – কিন্তু বুতান শব্দে তো কোন বিভক্তি নেই। তাহলে ওই শব্দটা বাক্যে ঢুকল কীভাবে? এটাকে কি বেআইনি অনুপ্রবেশ বলা যাবে? – বুতানের প্রশ্ন।

    – একেবারে কোন বিভক্তি নেই তা কিন্তু বলা যাবে না। বুতান শব্দে যে বিভক্তি আছে তাকে বলা হয় শূন্য বিভক্তি। একটু বুঝিয়ে বলি। পৃথিবীকে শূন্যের ধারণা কে দিয়েছে তা জানিস?

    – হ্যাঁ। ভারতীয় বিজ্ঞানী আর্যভট্ট। – মান্তু আজকাল নিয়মিত সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ছে।

    – ঠিক। তেমনি বাংলা ভাষা আমাদের শিখিয়েছে ‘শূন্য বিভক্তি’। এর কারণ কী জানিস? বাংলায় বিভক্তির খুব অভাব। মানে খুব বেশি বিভক্তি নেই আর কি। সংস্কৃত ভাষায় দেখবি প্রথমার একবচন ছাড়া শূন্য বিভক্তির প্রচলন প্রায় নেই। আসলে বাংলাতে শব্দ বিভক্তির সংখ্যা খুব কম। এ, কে, রে, তে (এতে), র (এর) এই পাঁচটা। এর মধ্যে র (এর) বিভক্তি সম্বন্ধপদের নিজস্ব চিহ্ন। আর রে বিভক্তি সাধারণত কবিতায় ব্যবহার হয়। অথচ দেখ কারক আছে ছয় রকমের। আর তোদের বলে রাখি যে ধাতু বা শব্দে বিভক্তি যোগ হলে পুরুষ, কারক, বচন কাল এগুলো বোঝা যায়। তাহলে বুঝতে পারছিস যে বাংলাতে বিভক্তির যথেষ্ট অভাব আছে। আর এই অভাব মেটানোর জন্য বাংলা ভাষার আবিষ্কার ‘শূন্য বিভক্তি’। অবশ্য এই অভাব মেটানোর আর একটা উপায়ও আছে। আর তা হল অনুসর্গ। দুই একটা উদাহরণ দিলে হয়তো তোরা ব্যাপারটা বুঝতে পারবি। “নবীন ওপাড়াতে সারারাত ধরে হরিনামের আসরে বসেছিল।” এই বাক্যে নবীন+০, ওপাড়া+তে, হরিনাম+এর, আসর+এ এগুলো বিভক্তি আর সারারাত ধরে, এই ধরে হল অনুসর্গ। যদি বলা যায় “এই কলমে লেখা যাচ্ছে না” বা “এই কলম দিয়ে লেখা যাচ্ছে না” এই বাক্য দুটোর অর্থ একই। কিন্তু প্রথম বাক্যে কলম শব্দের সঙ্গে এ বিভক্তি আর দ্বিতীয় বাক্যে কলম শব্দের সঙ্গে ‘দিয়ে’ অনুসর্গ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে মনে রাখিস বিভক্তি যেমন শব্দের সঙ্গে লেগে থাকে, অনুসর্গ কিন্তু বসে একটু তফাতে। আর বিভক্তিগুলোর আলাদা কোন অর্থ নেই কিন্তু অনুসর্গগুলোর আলাদা অর্থ আছে।

    – আচ্ছা দাদু, তুমি যে বললে, “বিভক্তি দিয়ে আমরা কারক চিনতে পারি” এই ব্যাপারটা কী? – বুতান জানতে চায়।

    – বিভক্তি দিয়ে কারক চেনা যায় বটে তবে যেহেতু অনেকগুলো কারকে একই বিভক্তি ব্যবহার করা যায় তাই সবসময় বিভক্তি দিয়ে কারক বোঝা যায় না। পরে যখন তোদের কারক সম্বন্ধে বলব তখন তোদের এই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। আজ এই পর্যন্তই থাক।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here
    Captcha verification failed!
    CAPTCHA user score failed. Please contact us!

    পদ

    মান্তু গুনগুন করছিল, '... আমার সুরগুলি পায় চরণ...' বুতান জিজ্ঞেস করল, 'আচ্ছা দাদু, চরণ মানে তো পা তাহলে সুর কী করে পা পাবে?' - একটা শব্দের...

    প্রত্যয়

    - প্রত্যয় মানে কী? - সকালবেলা বইখাতা নিয়ে হাজির বুতান আর মান্তু। আজ ওদের স্কুল ছুটি। - প্রত্যয় শব্দের মানে হল বিশ্বাস। তবে তোরা...

    উপসর্গ

    অনুসর্গ তো আমরা শিখেছি। অনুসর্গ যে বিভক্তির অভাব মেটাচ্ছে তাও জেনেছি। উপসর্গও কি তাই? - বুতানের স্কুলে বোধ হয় এখন উপসর্গ শেখান হচ্ছে। - না।...

    বিভক্তি, অনুসর্গ ও নির্দেশক

    মান্তু বলল, 'আচ্ছা দাদু, তুমি তো বললে যে বিভক্তি শব্দের সঙ্গে না জুড়লে তা বাক্যে ব্যবহারই করা যাবে না। আবার বললে কোন শব্দে শূন্য...

    লেখক অমনিবাস

    বিভক্তি, অনুসর্গ ও নির্দেশক

    মান্তু বলল, 'আচ্ছা দাদু, তুমি তো বললে যে বিভক্তি শব্দের সঙ্গে না জুড়লে তা বাক্যে ব্যবহারই করা যাবে না। আবার বললে কোন শব্দে শূন্য...

    বাংলা বানানের নিয়ম কানুন

    লক্ষ, লক্ষ্য, লক্ষ্যণীয় এই শব্দগুলোর বানান লিখতে গিয়ে আমাদের প্রায়ই ভুল হয়ে যায়। 'লক্ষ' লিখতে গিয়ে 'লক্ষ্য' লিখে ফেলি আবার এর উল্টোটাও কখনও কখনও হয়ে...

    ষত্ববিধি

    আজ মান্তু হাতে করে একটা চিঠি এনে হাজির। - দাদু, মৃন্ময় কাকু তোমাকে চিঠি লিখেছেন, এই নাও। আচ্ছা, কাকু তোমাকে চিঠিতে 'শ্রীচরণেষু' বলে সম্ভাষণ করেন...

    বাংলা সন্ধি

    বুতান মোহিতলাল মজুমদারের 'কালবৈশাখী' কবিতা পড়ছিল। পড়তে পড়তে 'আজিকে যতেক বনস্পতির ভাগ্য দেখি যে মন্দ' এই জায়গায় এসে থমকে গেল। -আচ্ছা দাদু, 'যতেক' শব্দের...

    ণত্ববিধি

    বুতান বলল, 'দাদু, তুমিও তো দেখছি ভুল বানান লিখছ। এগুলোকেই বোধ হয়' স্লিপ অফ পেন' বলে? - তা ভুল বানান যে না লিখি তা নয়।...

    উপসর্গ

    অনুসর্গ তো আমরা শিখেছি। অনুসর্গ যে বিভক্তির অভাব মেটাচ্ছে তাও জেনেছি। উপসর্গও কি তাই? - বুতানের স্কুলে বোধ হয় এখন উপসর্গ শেখান হচ্ছে। - না।...

    এই বিভাগে