“পুরান ঢাকা” এই শব্দযুগলের সাথে আভিজাত্য শব্দটা সবার আগে যুক্ত হবে। আমার কাছে মনে হয় বিশ্বের ঐতিহাসিক যত হেরিটেজ শহর আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আমাদের পুরান ঢাকা। কিন্তু আমরা কি তার যত্ন নিতে পেরেছি নাকি কোন দ্বিধা ছাড়াই আমাদের শত শত বছরের ঐতিহ্যের নগরকে ধ্বংস করেছি? চলুন এই উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পায়ে হেঁটে পুরান ঢাকা ঘুরে আসি।
খুব সকালে বাসা থেকে বের হলাম। আবদুল্লাহপুর এসে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনে উঠে পরলাম; গন্তব্য এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশন। শীতের আবেশ এখনো ঢাকা শহরকে আঁকড়ে ধরতে পারেনি, পূর্ব আকাশ রঙিন করে সূর্য উঠে পড়ল।ঢাকার কমলাপুর গামী ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়াল; পয়তাল্লিশ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে তাতে উঠে পড়লাম। ট্রেনে পা ফেলার জায়গা নেই— লোকে লোকারণ্য পুরো ট্রেন। ত্রিশ মিনিট পর ট্রেন কমলাপুর স্টেশনে এসে থামল, স্টেশন থেকে বের হয়ে ম্যাপের দিকে নজর দিলাম— কোথা থেকে শুরু করব।
![বলদা গার্ডেন](https://www.jegeachi.com/wp-content/uploads/2023/11/balda-gargen-225x300.webp)
কমলাপুর থেকে রিক্সা নিয়ে নিলাম বলধা গার্ডেন পর্যন্ত। সকাল বেলা ঢাকা শহরের অক্সিজেনের আধিক্যতা একটু বেশি থাকে তখন মনখুলে শ্বাস নেওয়া যায়— বাতাস তখন ভারি মনে হয় না। রিক্সা বলধা গার্ডেনের সামনে এসে থামল। বিশ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ভিতরে প্রবেশ করলাম। শারীরিক ব্যায়াম করার জন্য বয়স্ক লোকদের ভীড় লেগে আছে সাজান এই বাগানে। নানাবিধ পাখির কলতানে মুখোরিত পুরো বাগান— সেই সাথে বিভিন্ন গাছ পালায় সুসজ্জিত। সকাল বেলা এমন একটা সুন্দর পরিবেশ দিয়ে শুরু হয়ে দারুণ হয়েছে। পুরো বাগান একবার ঘুরে প্রদক্ষিণ করলাম। এরপর বাগানের পুকুর পাড়ে এসে বসে পড়লাম।
বলধা গার্ডেন এই উদ্যানে প্রচুর দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। ভাওয়াল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ১৯০৯ সালে বাগানটি প্রতিষ্ঠা করেন। ৩.৩৮ একর জায়গার ওপর এই উদ্যান নির্মাণ করা হয়েছে। নরেন্দ্র নারায়ণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দুর্লভ প্রজাতির গাছপালা এনে বাগানটি ক্রমাগত সমৃদ্ধ করেছেন। ইতিহাস থেকে এমনই জানা যায় কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর বাগানের উন্নয়ন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থা কিছুকাল চলার পর ১৯৬২ সালে এটি সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে হস্তান্তরিত করা হয় এবং বন বিভাগের ওপর সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বর্তায়।
উঠে আবারো হাঁটা শুরু করলাম। বলধা গার্ডেনের দুটি ভাগ আছে এটা আমি বাগানে থাকা অবস্থায় লক্ষ্য করিনি কিন্তু যখন এর ইতিহাস জানা শুরু করলাম তখন দারুণ একটা ইতিহাস জানলাম। ব্যাপারটা অনেকটা পৌরাণিক কাহিনীর মত— তাও অনেক ইন্টারেস্টিং। একটি অংশের নাম সাইকী এবং অন্যটি সিবলী। সাইকী অর্থ আত্মা ও সিবলী অর্থ প্রকৃতির দেবী। দুটি শব্দই গ্রিক পৌরাণিক শব্দ। সাইকী অংশের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে নীল, লাল, সাদা, হলুদ, জাতের শাপলায় ভরা অনেকগুলো শাপলা হাউস, বিরল প্রজাতির দেশি বিদেশি ক্যাকটাস, অর্কিড, এনথুরিয়াম, ভূজ্জপত্র গাছ, বিচিত্র বকুল, আমাজান লিলি ও সুড়ঙ্গসহ একটি ছায়াতর ঘর। সিবলী অংশের মূল আকর্ষণ হচ্ছে শঙ্খনদ, পুকুর, ক্যামেলিয়া, অশোক, আফ্রিকান টিউলিপস। এই হচ্ছে বলধা গার্ডেনের ইতিহাস।
বলধা গার্ডেনের এই ভাগের ইতিহাসটা আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে। বলধা গার্ডেন উপভোগ শেষে এবার বের হয়ে পরলাম ভিতর থেকে, বের হয়ে আবার ম্যাপ বের করলাম। এবার সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে এখান থেকে হাঁটা শুরু করব, তারপর একদম আজিমপুর পর্যন্ত এভাবেই হেঁটে হেঁটে ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলো দেখব।
বলধা গার্ডেনের দিয়ে বের হয়ে নারিন্দা রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই নারিন্দা রোডে পরপর দুটি পুরাতন বাড়ি চোখে পড়ল যার একটিতে মানুষজন বসবাস করে আরেকটি চরম অবহেলায় পড়ে আছে। কি দারুণ ছিল সেই বাড়িটার কারুকার্য। দ্বিতল এই বাড়িটার সামনের দোতলা অংশে বিশাল বারান্দা এখনও তার সৌন্দর্য্য প্রকাশ করে।
![শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হূমায়ুন সাহেবের পৈত্রিক বাড়ি। শরৎ গুপ্ত রোড।](https://www.jegeachi.com/wp-content/uploads/2023/11/father-home-of-nurul-mazid-jpg.webp)
নারিন্দা রোড থেকে শরৎ গুপ্ত রোডে প্রবেশ করলাম। ঘিঞ্জি রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি আস্তেধীরে বাড়ছে— সাথে যানবাহনের চাপ— যানবাহন বলতে রিক্সা, সিএনজি, সাইকেল, মটরবাইক এসব। আমি আনমনে সামনে হাঁটতে থাকলাম। প্রথম যে বাড়িটা চোখে পড়ল সেটি শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হূমায়ুন সাহেবের পৈত্রিক বাড়ি। দারুণ এই বাড়িটা কত সালে নির্মিত তা জানতে পারিনি, এমনকি ভিতরেও প্রবেশ করতে পারিনি— বাহির থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।অপরুপ সৌন্দর্যের বারান্দা, জানালা তার সাথে চমৎকার সব কারুকার্য শোভা পেয়েছে বাড়িটিতে। পুরান ঢাকার এসব প্রায় বাড়িতেই লোকজন বসবাস করে তাই চাইলেই এসব বাড়ি সরাসরি ভিতরে গিয়ে দেখার সুযোগ কম।
এই বাড়িটা দেখে সামনে আবারও হাঁটা শুরু করলাম। একটু এগুতেই চোখে দ্বিতল আরেকটি ভবন পড়ল, সাদা রঙের সেই ভবনটিতে রাজকীয় একটা ভাব আছে। আভিজাত্যের ছোঁয়া লেগে আছে পুরো বাড়িটা জুড়েই। বাড়ির মালিক হিসেবে ডা. মো গিয়াস উদ্দিনের নাম লাগান। কে এই গিয়াসউদ্দিন তা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। আমি মাঝে মধ্যে ইতিহাস লিখতে গিয়ে লিখি কিছু ইতিহাস অজানাই থাক।
নারিন্দা এরিয়াতে আছি নারিন্দা সম্পর্কেও কিছু জেনে নেই। আগেই বলেছি পুরান ঢাকার সাথে আভিজাত্য শব্দটার সম্পর্ক খুবই দারুণ। নারিন্দার ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তা হল— মোগল শাসনামল থেকেই এখানে জনবসতি রয়েছে। এই এলাকাটির নাম এসেছে নারায়ণদিয়া শব্দের অপভ্রংশ হতে, যার অর্থ হলো নারায়ণের দ্বীপ। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আগমনকারী পর্তুগিজ পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী সেবাস্তিয়ান মানরিকের বর্ণনায় নারিন্দার উল্লেখ পাওয়া যায়। সে সময় এই এলাকাটি ছিল সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকা শহরের পূর্ব সীমান্ত। পরবর্তীকালে, বিশেষ করে ইংরেজ শাসনামলে ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা যখন কমে আসে, তখন নারিন্দা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগে গেন্ডারিয়া ও নারিন্দা এলাকাকে আবাসিক এলাকা হিসাবে গড়ে তোলা হয়। এই হলো নারিন্দার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
![নাসিরুদ্দিন স্মৃতি ভবন](https://www.jegeachi.com/wp-content/uploads/2023/11/nasiruddin-smriti-bhaban-sharat-guha-road-jpg.webp)
এবার আবারও হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর হাঁটার পরই উঁচু প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত আরেকটি ভবনের দেখা পেলাম।যেটিতে বড় করে লেখা নাসিরউদ্দিন স্মৃতি ভবন। এই ভবনের ভিতরে যাওয়ারও কোন অবস্থা নেই। এটি নিয়ে অনেকদিন মামলা মোকদ্দমা চলেছে। যাই হোক এবার এই দ্বিতল সাদা ভবনটির ইতিহাস জেনে আসি। সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ও বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম এবং সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের স্মৃতিবিজড়িত ‘নাসির উদ্দিন স্মৃতি ভবন’।
সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দিন, বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগম এবং শিশুসাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই গেন্ডারিয়ার নারিন্দা এলাকার শরৎগুপ্ত রোডের এই বাড়িতে বসবাস করতেন। যেটি ‘নাসির উদ্দিন স্মৃতি ভবন’ নামে পরিচিত। ১৮৯০ সালের দিকে কিশোরগঞ্জের কোনও এক হিন্দু জমিদার এটি তৈরি করেছিলেন। সম্প্রতি নূরজাহানের ছোট মেয়ের জামাই এই বাড়ি ভেঙে বহুতল ভবন তৈরির চেষ্টা করছেন। এ নিয়েই মামলা মোকদ্দমা চলছে। ঐ যে আগেই বলেছি আমাদের পুরান ঢাকা আমরাই ধ্বংস করেছি, আধুনিকতার ছোয়ায় এক ঘিঞ্জি নগরে পরিণত করেছি ঐতিহাসিক এক নগরকে।
এবার আবার হাঁটা শুরু করলাম। একদম শরৎ গুপ্ত রোডের শেষ প্রান্তে গিয়ে হাজির হলাম। এক নামকরা বাড়ির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ির গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। শক্তি ঔষধালয়ের নাম শুনেছি— শতবর্ষী এই ঔষধ কোম্পানির মালিক এবং প্রতিষ্ঠাতা মথুরামোহন চক্রবর্তীর বাড়ি। বাড়ির ভিতরে একটি মন্দিরও আছে। দারুণ কারুকার্যে বাড়িটা নির্মাণ করা হয়েছিল। দ্বিতল এই বাড়িটির কয়েকটা জায়গায় টান এবং ঝুল বারান্দা দেখলাম। সবকিছু মিলিয়ে দারুণ একটা উপভোগের জায়গা— যদিও ভিতরে অনেক ক্ষয় হয়ে গিয়েছে। বাড়িটি অযত্নে ব্যবহার হচ্ছে বহুদিন যাবত। ‘মথুর বাবু’ (১৮৬৮–১৯৪২) ছিলেন একজন বাংলাদেশী বাঙালী আয়ুর্বেদাচার্য ও ঢাকার জুবিলী স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি ১৯০১ সালে ঢাকাতে একটি ঐতিহ্যবাহী ও লাভজনক আয়ুর্বেদ-ভিত্তিক গবেষণাকেন্দ্র শক্তি ঔষধালয় স্থাপন করে বিখ্যাত হন। একদা তিনি অসুস্থ হলে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মচারীর কৃপায় সুস্থ হলে তাঁর নির্দেশে আয়ুর্বেদ চর্চা শুরু করেন— যার ফলে শক্তি ঔষধালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মথুরামোহনের আয় থেকে অর্ধেক নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং বাকি অর্ধেক মানবকল্যাণে ব্যয় করতেন।