সপ্তাহের সেরা

    আখ্যাত রচনা

    রসিক রবীন্দ্রনাথ

    বৈবাহিক!
    সে সময় শান্তিনিকেতনের গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি রাতে বাড়িতে গিয়ে পড়ার জন্য প্রতিদিন গ্রন্থাগার থেকে অনেকগুলো বই বোঝাই করে নিয়ে ফিরতেন।
    এমনই এক সন্ধ্যায় তিনি বেশ কয়েকটা পছন্দের বই সঙ্গে নিয়ে গ্রন্থাগার থেকে বাড়ি ফিরছেন। এমন সময় রবীন্দ্রনাথ তাকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন, ‘ওহে বৈবাহিক, শুনে যাও দেখি একবার।’
    রবীন্দ্রনাথের মুখে এই কথা শুনে অবাক প্রভাতকুমার! কেন গুরুদেব এমন বললেন!–
    এ কথা ভাবতে ভাবতে রবীন্দ্রনাথের সামনে এসে তিনি বললেন, ‘গুরুদেব, আপনি আমাকে কেন বৈবাহিক বলছেন?’
    গুরুদেব হেসে বললেন, ‘আরে, তুমি সেই বৈবাহিক নয়, তুমি বই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে আমি তোমাকে বই-বাহিক বলে ডাকছি। বুঝলে ?’

    ইংল্যান্ডে ইংরেজি :
    কবিগুরুর এক ঘনিষ্ট আত্মীয় ইংল্যান্ডে গিয়ে কবিগুরুকে চিঠি লেখেন। আত্মীয়ের ইংল্যান্ডে যাবার খবর শুনে একটু অবাক হলেন রবীন্দ্রনাথ। কারণ, আত্মীয়টির যা ইংরেজি বলার ধরণ! আত্মীয়টির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিয়মিত পত্র বিনিময় হত। তার ইংল্যান্ড যাবার খবর শুনে আত্মীয়টিকে মজা করে রবীন্দ্ৰনাথ লিখলেন—’কী হে, বিলেতে তো সবার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। তোমার যা ইংরেজি বিদ্যে,
    তা – ও দেশে তোমার কথা বলতে অসুবিধা হয় না?’
    রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি পেয়ে মজা করে আত্মীয়টি প্রত্যুত্তরে লিখলেন–আসলে আমি তো Fluently বলে যাই। সেক্ষেত্রে আমার কোনো সমস্যা হয় না। তবে হ্যাঁ–আমার কথা যাঁরা শুনছেন তাঁদের কোনো অসুবিধা হয় কি না। আমি ঠিক বলতে পারব না। ’
    এই চিঠি পড়ে হাসলেন কবিগুরু।

    শান্তিনিকেতনে বাঁদর !
    শান্তিনিকেতনে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তাঁর পুত্রবধু প্রতিমা দেবী। তখন দুপুর বেলা। রবীন্দ্ৰনাথ বিছানায় শুয়ে আছেন। পাশে একটি চেয়ারে বসে প্রতিমা দেবী। দুজনে নানারকম কথাবার্তা বলছেন। রবীন্দ্রনাথ কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রতিমা দেবীকে বললেন, ‘বৌমা, বাঁদোরটা বড্ড জ্বালাচ্ছে, ওটা বন্ধ করে দাও তো!’ চারদিক তাকিয়ে দেখলেন প্রতিমা দেবী। কই, কোথাও বাঁদর চোখে পড়ল না। আর তাছাড়া কীভাবেই বা বাদরকে বন্ধ করবেন!
    কী করে বলবেন গুরুদেবকে এই কথা?
    ভাবতে লাগলেন প্রতিমা দেবী।
    রবীন্দ্ৰনাথ আবার বললেন, বৌমা, কী হ’ল? দেখছি না, বাঁদোরটা বড্ড জ্বালাচ্ছে!’
    প্ৰতিমা দেলী এবার বললেন, কই, বাঁদর তো আমার চোখে পড়ছে না।’
    রবীন্দ্ৰনাথ এবার হেসে বললেন, ‘বাঁদর-মানে বাঁ-দোরটা বন্ধ করতে বলছি, দাখো না, রোদ এসে বড্ড মুখে লাগছে যে ‘
    এ কথা শুনে প্ৰতিমা দেবী হেসে ফেললেন এবং বামদিকের দোরটা বন্ধ করে দিলেন।

    পোকার উৎপাত !
    শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্ৰনাথ নিজেই ছাত্রদের পড়াতেন। একদিন ইংরেজি ক্লাসে তিনি বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলীর কবিতা পড়াচ্ছেন। শান্তিনিকেতনে গাছের তলায় মনোরম পরিবেশে পড়াশোনা হয়। গুরুদেব বসেছেন মাঝখানে। তার চারপাশে ছাত্রদল। সেই সময় হঠাৎ কিছু পোকার উৎপাত শুরু হল। গুরুদেবের পরণে গা পর্যন্ত ঝোলা জেকবা। তার গায়ে পোকা কাটতে পারছে না। কিন্তু অল্পবয়স্ক ছাত্রদের গায়ে পোকা কামড়াতে লাগল। স্বভাবতই তারা পোকার জ্বালায় অস্থির! পড়ায় মন লাগছে না, শুধু তারা গা-হাত-পা চুলকাতে লাগিল! রবীন্দ্রনাথ কিছুই বুঝতে পারেন না কোন ছাত্রদল ওরকম করছে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘কী হল? আজি তোমরা এত অস্থির কেন?’
    ছাত্রদলের মধ্যে থেকে প্রমথনাথ বিশী উঠে বললেন, ‘গুরুদেব, যদি অভয় দেন তো বলি, কেন আমরা অস্থির!’
    রবীন্দ্ৰনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো বলে।’
    তখন প্রমথনাথ বললেন, ‘গুরুদেব, আপনি আমাদের শেলীর কবিতা পড়াচ্ছেন, কিন্তু এদিকে কীট্‌স আমাদের বড়ই বিরক্ত করছেন।,
    রবীন্দ্রনাথ সব বুঝে হেসে ফেললেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একবার ক্ষিতিমোহন সেন সহ কয়েকজন ছাত্রকে ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা পড়াচ্ছিলেন, সেদিনও পোকা-বিভ্ৰাট হয়েছিল।

    কুন কাজ নাই !
    একদিন রবীন্দ্ৰনাথ উত্তরায়ণের বারান্দার এক কোণে চেয়ার-টেবিলে বসে মগ্ন হয়ে কবিতা লিখছিলেন। বাগানে একটি সাঁওতাল মেয়ে সেই সময় ঘাস পরিস্কার করছিল। কাজ শেষ হলে বিকেলে মেয়েটি রবীন্দ্রনাথের পাশটিতে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটিকে দেখে রবীন্দ্রনাথ লেখা থামিয়ে বললেন, ‘কী রে, কিছু বলবি?’
    মেয়েটি এবার বলল, ‘হ্যাঁরে, তুর কি কুন কাজ নাই? সুকালবেলা যখন কাজে এলম, দেখলাম তুই এখানে বসে কী করছিস! দুপুরেও দেখলাম, এখানে বসে আছিস! এখন আবার সনঝেবেলা আমাদের ঘরকে যাবার সময় হয়েছে–এখনও তুই এখানে বসে আছিস! আচ্ছা, তুকে কি কেউ কুন কাজ দেয় নাই?’
    মেয়েটির মুখে এই কথা শুনে রবীন্দ্ৰনাথ হেসে ফেললেন। ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের রবীন্দ্ৰনাথ নিজেই এই গল্পটা শুনিয়ে বলতেন, ‘দ্যাখো, সাঁওতাল মেয়েটার কী বুদ্ধি দ্যাখো! আমার স্বরূপটা ও ঠিক ধরে ফেলেছে।’

    মিষ-টক!
    খাদ্যরসিক রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই শান্তিনিকেতনে তাঁর আত্মীয় ও বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। আসলে রবীন্দ্ৰনাথ যেমন খেতে ভালবাসতেন, তেমন খাওয়াতেও ভালবাসতেন। কবিগুরুর খাসভৃত্য বনমালী এই খাবারের ব্যবস্থা করত। একবার গরমকালে রবীন্দ্রনাথের কাছে এসেছেন তাঁর আত্মীয় ও প্রথম যুগের চলচ্চিত্র অভিনেতা ধীরেন্দ্ৰনাথ গাঙ্গুলী। যিনি ডি.জি নামেও পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ধীরেন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কাটে শান্তিনিকেতনেই। তিনি বালক বয়সেই অভিনয়, সংগীত, অঙ্কন, যন্ত্রবাদনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। উনি রবীন্দ্ৰনাথের কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত হন ও ‘বাল্মিকী প্ৰতিভা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অভিনয় করেন। রবীন্দ্ৰনাথ হয়েছিলেন বাল্মিকী, ডি.জি হয়েছিলেন মায়া। ধীরেন্দ্রনাথ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের সম্পূর্ণ বাংলা ছবি ‘বিলেত ফেরত’ তৈরী করেন। ১৯২১ সালে ২৬ ফ্রেব্রুয়ারি ভবানীপুরের রসা থিয়েটারে ছবিটি মুক্তিলাভ করে। এই ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেন ডি. জি। রবীন্দ্ৰনাথ ধীরেন্দ্রনাথকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তাই তিনি আসায় বিশেষ ভোজনের ব্যবস্থা করা হল। বনমালী বাজার থেকে আম কিনে আনল। কবি ও ডি.জি একসঙ্গে খেতে বসেছেন। আম খেতে শুরু করে ধীরেন্দ্রনাথের মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। রবীন্দ্ৰনাথ ব্যাপারটা আন্দাজ করে বললেন, ‘কী ধীরু, আমটা মিষ্টি তো?’
    কী আর বলেন ধীরেন্দ্ৰনাথ! তিনি চুপ করে হাসলেন। বনমালী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আম মিষ্টি, আমি চাখিয়ে নিয়ে তবে কিনেছি। মিষ্টি না হওয়ার কারণ নেই।’
    রবীন্দ্ৰনাথ এবার হেসে বললেন, ‘আসলে বনমালী যাকে দিয়ে আম চাখিয়েছে সে আমওলারই লোক। আম চেখে সে নিশ্চয়ই বলেছিল মিষ-টক। আর বনমালী শুনেছে মিষ্ট। ওর আর কী দোষ?’
    রবীন্দ্ৰনাথের এই কথা শুনে ধীরেন্দ্ৰনাথ হেসে ফেললেন।

    নকল নবিস
    নকল নবিসhttp://www.jegeachi.com
    নকল নবিস ব্যক্তি বিশেষ নয়, খোদ ‘জেগে আছি’র সম্পাদকীয় দপ্তর। অজ্ঞাত উৎসের লেখা সমূহ নকল ও সম্পাদনা করে ‘জেগে আছি’তে প্রকাশ করাই ‘নকল নবিসে’র কাজ। প্রয়োজন আইন মানে না, নকল নবিসও প্রয়োজনের পূজারী।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here
    Captcha verification failed!
    CAPTCHA user score failed. Please contact us!

    নজরুল সংগীতের সুরবিকৃতি

    নজরুল সংগীতের সুরবিকৃতির সমস্যাটি অনেকদিন ধরে চলছে। কবির সুস্থাবস্থায় গ্রামোফোন শিল্পীদের কণ্ঠে যে সুরে গান রেকর্ড করা হয়েছিল, পরবর্তীকালের অনেক শিল্পীরাই সেই সুর বজায়...

    লেখক অমনিবাস

    পটুয়া কামরুল হাসান

    পটুয়া — এই শব্দটি উচ্চারন করলেই যার নামটি সবার মনে ভেসে ওঠে তিনি শিল্পী কামরুল হাসান। এ দেশের চারু ও কারুকলায়, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরেই...

    কবিয়াল বিজয় সরকার

    কবিয়াল বিজয়কৃষ্ণ সরকার একজন কবিয়াল, কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও চারণ কবি।জন্ম ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯০৩ সালে নড়াইলের ডুমদী গ্রামে। তাঁর প্রকৃত নাম বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী।কবি...

    উ-কার ও ঊ-কারের ব্যবহার

    বাংলা বর্ণমালায় হ্রস্ব-উ ও দীর্ঘ-ঊ থাকলেও (যেমন কুল, কূল, দুর, দূর) উচ্চারণে এদের হ্রস্বতা বা দীর্ঘতা সংস্কৃতের মতো, যথাযথ রক্ষিত হয় না। এ জন্য...

    হৈমন্তী শুক্লা

    ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না; কিংবা আমার বলার কিছু ছিল না— এসব কালজয়ী গানের অন্যতম কণ্ঠশিল্পী হৈমন্তী শুক্লা।উপমহাদেশের আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তী শিল্পী...

    হরিকেলের রৌপ্যমুদ্রা

    হরিকেল প্রাচীন পূর্ববঙ্গের একটি জনপদ। খ্রিস্টীয় ‘সপ্তম শতকের’ প্রাচীন ভারতীয় লেখকগণ পূর্বভারতীয় একটি অঞ্চলকে হরিকেল বলে উল্লেখ করেন। তৎকালীন হরিকেল জনপদটি বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম,...

    ক্ষিতিমোহন সেন

    ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, লেখক ও সংগ্রাহক । ১৮৮০ সালের ২ ডিসেম্বর কাশীতে তাঁর জন্ম ৷ কিন্তু তাঁদের আদি নিবাস ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে।...

    এই বিভাগে