সপ্তাহের সেরা

    আখ্যাত রচনা

    ফিচারবিপন্ন সময়ে ভিন্ন ঘোর

    বিপন্ন সময়ে ভিন্ন ঘোর

    বিপন্ন সময়ে ভিন্ন ঘোর

    আমি আত্মমগ্ন মানুষ। নিজের সাথেই নিজের এত কথা আছে যে, অন্য আর কারও সাথে কথা বলার বা ভাব বিনিময়ের তাড়া সাধারণত তৈরি হয় না। কিন্তু গত প্রায় দশটি বছর ধরে তাঁর সাথে কথা বলার একটা বাসনা প্রায়ই টের পেতাম। গতকাল সেই মানুষটির সাথে কথা হলো। রবি চক্রবর্তী!

    নবতিপর মানুষটি থাকেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোন্নগরে। তাঁকেই গতকাল ফোন করেছিলাম। কথা হলো অনেকটা সময়। সেই কথার ভাব ও রেশ আমাকে বেশ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নিজের দেশের বিপন্ন সময়ে, মারী ও মড়কের এই গ্রহণকালে তাঁর সাথে কথা বলার পর থেকে বেশ একটা প্রশান্তি নেমে এসেছে মনে। কেন, ঠিক জানি না। হয়ত বাস্তবতা থেকে পালাতে চাইছিলাম, এক প্রকৃত মনীষার মুখোমুখি হওয়ায় সেই সুযোগ চলে এলো! কাল থেকে কতবার যে তাঁর কথাগুলো খণ্ড খণ্ড করে মনে পড়ছে। হয়ত অনেকের জন্য খুবই অকিঞ্চিৎকর সেসব। কিন্তু আমার জন্য তা বিকালের নরম কোমল কমলা আলোর মত প্রীতিকর এক অনুভব হয়ে উঠেছে।

    আমার পরিচয় পেয়ে, শুরুতেই কেমন একটা আক্ষেপ মাখা কণ্ঠে উনি স্মরণ করলেন তার পিতৃকুলের আবাস নাটোরের সিংড়া উপজেলার হাতিয়নদহ গ্রামের কথা। ছোট্ট ঘোলা জলের গুমনী নদীর কথা। ১৯৪৭ সালের পর তাঁর আর আসা হয়নি এই দেশে। জানালেন, এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে, মামার বাড়ি নড়াইল আর চিত্রানদীর স্বচ্ছ জলের স্মৃতি। শেকড় হারানো মানুষগুলোর এই বেদনার কথা আমাদের জানা। কিন্তু তারপরও যতবার শুনি ততবার বৃটিশদের জন্য কেমন একটা বীতরাগ করুণা তৈরি হয় আমার মনে।

    সেই ১৯২৯ সালে জন্ম রবি চক্রবর্তীর অথচ কথা যেমন পরিষ্কার, তেমনি মায়াভরা। অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন। কিন্তু কণ্ঠে যেন চিরনবীন শিক্ষার্থীর বিনয়! প্রতিটা শব্দ কেমন নরম আর ভেজা ভেজা। আমি নিশ্চিত, তাঁর কণ্ঠসুধা আমার কানে লেগে থাকবে অনেক অনেক দিন।

    ছিন্ন ছিন্ন নানান কথা হলো আমাদের। ১৯৪৬ সালের কলিকাতা দাঙ্গার কথাও উঠেছিল। বললেন, উনি তখনই জেনেছেন, দাঙ্গার সময় হিন্দু-মুসলিম দুই পক্ষকেই অস্ত্র-পাতির যোগান দিয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম। সেই দাঙ্গাতেই অনেকে বুঝে নিয়েছিল, মুসলমান-হিন্দুর একসাথে থাকা অসম্ভব। তবে উনারা জেনেছিলেন, কলকাতা তো বটেই, প্রায় পুরো বাংলাই পাকিস্তানের অংশ হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই জানাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তাদের এক বন্ধু। সেই বন্ধু বলেছিলেন, ‘ইস্পাহানির আর কত টাকা আছে, বিড়ালারা তার দশগুণ বেশি টাকা দিয়ে কলিকাতাকে ভারতের অংশ করে নেবে।’ হায় টাকা! ইতিহাসে তো কত কথাই পড়ি। সেই সময় পূর্ববাংলার কলিকাতাবাসী একজন মানুষ যখন আবেগমন্থিত ওই স্মৃতি মেলে ধরছিলেন তখন আমার মনে বেজে চলেছিল কৃষ্ণনগরের বৈভব ছেড়ে আসা আমার পূর্বপুরুষের বিচ্ছেদবেদনার গল্প।

    রবি চক্রবর্তী উনার এক উপলব্ধির কথা বললেন। আনকোরা কিছু নয়। কিন্তু উনার সে উপলব্ধির কথায় আমার মনে নতুন একটা চিন্তা খেল গেল। সে চিন্তার কথা থাক। তাঁর থেকে আমি নিজের মত করে যা বুঝলাম তাই বরং বলি— দেশভাগের পর কলিকাতার মানসলোকের সাথে আর মাটির যোগাযোগ রইল না। পূর্ববাংলার মানুষ আর প্রকৃতি থেকে যে প্রাণরস নিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির সাধনা চলছিল কলিকাতায় তাতে ছেদ পড়ে গেল। সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তার সাহিত্য-সংস্কৃতি। কিন্তু ঢাকার সাথে রইল শেকড়ের যোগ। তারই প্রমাণ, ঢাকা অনেক অনেক এগিয়ে চলেছে, অনেক কাজ হচ্ছে সেখানে।

    আমাদের কথা ঘুরে যাচ্ছিল নানান প্রসঙ্গে। ত্রৈমাসিকের মীজানুর রহমান থেকে লোকবুদ্ধিজীবী চমস্কি বা ভাষাবিজ্ঞানী সস্যুর হয়ে রবীন্দ্রনাথ কিংবা উনার জন্মদিনে মৃত্যুবরণ করা জীবনানন্দ বা একদিন আগে ২৩শে অক্টোবর জন্ম নেওয়া শামসুর রাহমান প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন! কিন্তু চকিত সেই সব আলাপের প্রতিটি শব্দই যেন নতুন মুদ্রার মত চকচকে। রবীন্দ্রনাথ কেন ‘ভাষা, শিক্ষার মাধ্যম’ কথাটা লিখেননি, লিখেছেন ‘শিক্ষার বাহন’, সেসব কথাও উঠল।

    আমি জানালাম, (হয়ত এই কথাটুকু জানানোর জন্যই তাঁর সাথে কথা বলতেই চাইছিলাম) আমার এই জীবনে তাঁর আর কলিম খানের অবদানের কথা। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে আমার প্রতিটি মুহূর্ত যে শেখার আর জানার আনন্দে ভরা তার রূপকার তো তাঁরাই। তাঁর কাছ থেকেই তো প্রথম জেনেছি, তোতাপাখির মত ‘পরস্পরবিরোধী মতামতের প্রসারণ-খাত মাত্র’ না হয়ে নিজের বিচার ক্ষমতা তৈরি করতে পারাটাই শিক্ষার গোড়ার কথা। তাঁর কথাই তো মেনে নিয়েছি, মনে রেখেছি— ‘আমাদের দেশের ভাবনালোক থেকে বিচ্ছিন্ন পশ্চিমী ধ্যানধারণাসর্বস্ব উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে একটি কৃত্রিম কাগজের ফুল।’ এই কথাটুকুই তো ঘরের চাবি ভেঙে আমার আনন্দ-চর্চার দুয়ার হঠাৎ খুলে দিয়েছে। আমি জেনেছি, কী আমার কর্তব্য, কোথায় আমার আনন্দ!

    আমার শ্রদ্ধা জানবেন রবি চক্রবর্তী। আমার, আমাদের দিশা হয়ে বেঁচে থাকুন আপনি।

    আর রাজী
    আর রাজী
    আর রাজীর জন্ম নাটোরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা'য় পড়াশোনা শেষে বর্তমানে অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত আছেন।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here
    Captcha verification failed!
    CAPTCHA user score failed. Please contact us!

    চার্লি চ্যাপলিন

    ১৯৭২ সালে ৮৩ বছর বয়সে যখন অস্কার নিতে মঞ্চে ওঠেন, টানা বারো মিনিট হাততালির ঝড় বয়ে যায় অস্কার মঞ্চে। অস্কারের ইতিহাসে সেটাই ছিল দীর্ঘতম...

    পটুয়া কামরুল হাসান

    পটুয়া — এই শব্দটি উচ্চারন করলেই যার নামটি সবার মনে ভেসে ওঠে তিনি শিল্পী কামরুল হাসান। এ দেশের চারু ও কারুকলায়, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরেই...

    ক্ষিতিমোহন সেন

    ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, লেখক ও সংগ্রাহক । ১৮৮০ সালের ২ ডিসেম্বর কাশীতে তাঁর জন্ম ৷ কিন্তু তাঁদের আদি নিবাস ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে।...

    হৈমন্তী শুক্লা

    ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না; কিংবা আমার বলার কিছু ছিল না— এসব কালজয়ী গানের অন্যতম কণ্ঠশিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। উপমহাদেশের আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তী শিল্পী...

    কবিয়াল বিজয় সরকার

    কবিয়াল বিজয়কৃষ্ণ সরকার একজন কবিয়াল, কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও চারণ কবি। জন্ম ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯০৩ সালে নড়াইলের ডুমদী গ্রামে। তাঁর প্রকৃত নাম বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী। কবি...

    রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    গুরুদেবের পাশের ওই ব্যক্তিটির একক ছবি দিয়েও আজকের এই পোষ্ট দেওয়া যেত। হয়তো সেটা সঙ্গতও হত। কিন্তু ওই ব্যক্তিটি নিজের জীবনে নিজেকে কখনই 'রবীন্দ্রনাথ'...

    টমাস আলভা এডিসন

    পিতৃহারা ৭-৮ বছর বয়সের ছেলেটি স্কুল হতে বাড়ীতে এসে মাকে বলল, "মা, প্রিন্সিপাল আমাকে আদর করে কিছু ক্যান্ডি দিয়েছে। আর, তোমার জন্য এই চিঠিটা।" মা...

    লেখক অমনিবাস

    প্রসঙ্গ: মনের-বনের পশু, জবাই ও কুরবান

    শিক্ষিত-বাঙালী আর সব কিছু নিয়ে যা করে "মনের পশু" নিয়েও সে তাই শুরু করছে। শব্দের ব্যবহারে কাজী নজরুল ইসলাম খোদাপ্রদত্ত প্রতিভা। উনি শহীদী-ঈদ কবিতায়...

    শিক্ষা না-কি বিদ্যা, কিসে মুক্তি মানুষের?

    বিদ্যার দেবী সরস্বতী- এই বাক্য অনেকেই জানেন। পশ্চিমে জ্ঞানের দেবী যে এথেনা- এ কথাও বিস্তর মানুষের জানা। বিদ্যার দেবী আছে, জ্ঞানের দেবী আছে কিন্তু...

    এই বিভাগে